Whole Grain(গোটা শস্য)। এটি অপরিশোধিত শস্য। যা কোন প্রক্রিয়াকরণ ছাড়া উৎপাদন করা হয়। এধরণের শস্যগুলোর কয়েকটি স্তর থাকে- ব্র্যাণ, অ্যালুরেন, এন্ডোস্পার্ম, জার্ম স্তর।
যেমন, ধানের তুষ ফেলে দেওয়ার পর যা পাওয়া যায় তা হলো ব্র্যাণ। ব্র্যান এর পরবর্তী স্তর অ্যালুরেন, এর মাঝখানের অংশ হলো এন্ডোস্পার্ম ও এন্ডোস্পার্মের অভ্যন্তরীণ একটি ছোট স্তর থাকে, যাকে বলা হয় জার্ম। এদের সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।
ব্র্যান(কুড়া)- ধানের তুষকে আলাদা করার পর চাল বা শস্য দানার উপর লাল এবং পাতলা একটি স্তর লক্ষ্য করা যায়। এই স্তর হলো ব্র্যান। এই পাতলা আবরণ(ব্র্যান) তৈরি হয় সেলুলোজ দিয়ে। অ্যালুরেন স্তর- ব্র্যানের পরের স্তর হলো অ্যালুরেন স্তর। এর ফলে শস্য আকড়া থাকে বা আবদ্ধ থাকে। এই অ্যালুরেন স্তরে রয়েছে প্রোটিন ভিটামিন ও মিনারেল। সাধারণত ঢেঁকিতে চাল ভাঙলে এই স্তরটি অক্ষুন্ন থাকে। মেশিনে ধান ছাঁটাইয়ের ফলে অ্যালুরেন স্তর বিভক্ত হয়ে শস্যের রঙ বদলে মসৃণ হয়। এর ফলে প্রোটিন ও ভিটামিনের মাত্রা কমে যায়।এন্ডোস্পার্ম(শস্য)- এটি হলো মূল দানা। এটি শস্যের ৭৫ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত থাকে।
এই দানার পুরো অংশে রয়েছে ৭৭-৭৯ শতাংশ শ্বেতসার। এর প্রান্তদেশে আয়োডিন, প্রোটিন ও সামান্য লৌহ উপাদান থাকে। জার্ম(ভ্রুণ)- শস্য দানার একদম নিম্ন প্রান্ত অর্থাৎ বোঁটার কাছের অংশে জার্ম(ভ্রুণ) এর অবস্থান। এতে ভিটামিন ই, রিবোফ্লাভিন, থিয়ামিন, নিয়াসিন, লৌহ ও স্নেহ পদার্থ বিদ্যমান থাকে। সাধারণত আমরা সাদা চালের সাথে সবাই পরিচিত। এই সাদা চালে এন্ডোস্পার্ম ছাড়া অন্য কোন উপাদান অবশিষ্ট থাকে না। যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।আমরা মূলত ব্রাউন রাইসকে গ্রাইন শস্য হিসেবে জানি। কিন্তু অনেক প্রকার হোল গ্রেইন/ গোটা শস্য পাওয়া যায়।চলুন পরিচিত হই কিছু প্রকার হোল গ্রেইন শস্য সম্পর্কে৷ নানা ধরনের Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্য রয়েছে।
ব্রাউন রাইস
ব্রাউন রাইস(বাদামী চাল) Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্য। যা প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই শুধুমাত্র ধানের খোসা ছাড়িয়ে উৎপাদন করা হয়। এটি পুষ্টিগুণ উচ্চ রাখতে সাহায্য করে। সাদা ভাতের তুলনায় এর চালের ভাত তুলতুলে টেক্সচারের হয় ও বাদামের ফ্লেভার পাওয়া যায়। এটি লো ক্যালোরি, ফ্যাট ও গ্লুটিন মুক্ত। এছাড়া এতে বিভিন্ন পুষ্টিগুণ রয়েছে। ব্রাউন রাইসে ফাইবার, মিনারেল, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং সেলেনিয়াম, ভিটামিন বি ও ভিটামিন কে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্লেভেনয়েড, প্রোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিড বিদ্যমান থাকে।
এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
হজমতন্ত্রকে অপ্টিমাইজ করে। কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপরোসিস রোধ করতে সাহায্য করে।
রেড রাইস(লাল চাল)
রেড রাইসও ব্রাউন রাইসের মতো Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্য। এর খোসা ছাড়ানোর পর সামান্য পলিস করা হয়। ফলে এর ব্র্যান কিছুটা উঠে যায়। এর অ্যান্সোসায়ানিন লাল রঙের হয়, যা ব্র্যানের রঙ, হালকা ফ্যাকাশে বাদামী ধরনের।এর স্বাদ বাদমের মতো। ব্র্যানকে অক্ষুণ্ণ রেখে এই চাল খাওয়া হলে এর পুষ্টিগুণ অনেক ভালো থাকে। লাল চালে সাদা চালের তুলনায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। এতে লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক বিদ্যমান থাকে।
এই চাল ও ব্রাইন চালে একই ধরনের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা বহন করে।
ওটস
এটি একটি Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্য। এগুলো শীতকালীন সময়ে জন্মায়। ইংরজিতে Ots Avena Sativa নামে পরিচিত। এতে রয়েছে উচ্চমানের পুষ্টিগুণ। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার ওটস। পোল্যান্ড, রাশিয়া, কানাডা, ইউরোপ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে ব্যপকভাবে চাষ করা হয়।
এটি কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবারের ভালো একটি উৎস। অন্যান্য খাবারের তুলনায় এতে প্রোটিন ও ফ্যাট বেশি পরিমানে রয়েছে। ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ফোলেট, জিংক, ভিটামিন বি ১, থিয়ামিন, ভিটামিন বি ৫, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি৬ (পিরিডিক্সিন, ভিটামিন বি৩, নিয়াসিন) এর মতো উপাদান সমৃদ্ধ হয় এই ওটস। আরো আছো আলফা-টোকোটিরিন, আলফা- টোকোফেরলের মতো উপাদান, যা দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কাজ করে। এতে থাকা প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান মানুষের হৃদরোগ জনিত সমস্যা রোধ করে ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
অতিরিক্ত ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে। ফলে ওজন কমে। এতে রয়েছে বেটাগ্লুকন যা অক্ষতিকর কোলেস্টরল কমিয়ে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাখতে সাহায্য করে। প্রোটিন চাহিদা মেটায় ও ফাইবার দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। ডায়বেটিস প্রতিরোধ করে। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। এতে থাকা ম্যাগনেশিয়াম রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ফাইবার দেহের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়া আরো অনেক শারীরিক সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভুমিকা পালন করে।
ভুট্টা
ভূট্টা Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্য মধ্যে একটি। এর উৎপত্তি হয়েছিল মেসো আমেরিকায়। এই ভূট্টাতে ধান ও গমের তুলনায় বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে। ভূট্টাতে রয়েছে প্রোটিন, এ্যামিনো এসিড, ট্রিপটোফ্যান ও লাইসিন।
এর দানায় প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে ক্যারোটিন (ভিটামিন A) ৯০ মিলিগ্রাম পরিমাণ বিদ্যমান থাকে। ভূট্টা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে, দৃষ্টির জন্য উপকারী, ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখে, আয়রন ও রক্তশূণ্যতার ঘাটতি পূরণ করে, হৃদরোগের জন্য উপকারী, হজমে সাহায্য করে, কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
গম
গম Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্যের মধ্যে অন্যতম একটি। এর উৎপত্তি হয় মধ্যপ্রাচ্যের লেভান্ট অঞ্চলে। এর থেকে আটা ও উৎপাদিত হয়।এই গম থেকে রুটি, বিস্কুট, কেক, পিঠা, পাস্তা, নুডলস সহ নানা রকম খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এতে অমিষ, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্যরোটিন, ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২, ফাইবার, মিনারেল সহ আরো কিছু উপাদান বিদ্যমান রয়েছে।শরীরের উপকারীতায় গমের পুষ্টিগুণ অনেক কার্যকরী। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, স্ট্রোক প্রতিরোধ করে। লিভার ডিটক্সের জন্য সাহায্য করে। স্কিন ও চুলের জন্যেও গম একটি উপকারী শস্য।
ব্ল্যাক রাইস
এটি পর্পেল(বেগুনি) চাল হিসেবেও পরিচিত। এর টেক্সচার কিছুটা চটচটে বা অঠালো ধরনের হয়। রান্নার পরে এর রঙ গাঢ় বেগুনি হয়ে যায়। এটি Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্যের মধ্যে আরো একটি শস্য।
এতে রয়েছে অ্যান্থাসানিন, ফাইবার, ভিটামিন, প্রোটিন, জিঙ্ক, মিনারেলের মতো বেশকিছু উপাদান। ব্ল্যাক রাইস খেলে ক্যান্সার প্রতিরোধে সহয়তা করে, কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ওয়াইল্ড রাইস (বন্য চাল)
Whole grain(হোল গ্রেইন) মধ্যে একটি ওয়াইল্ড রাইস। যা মানুমিন, নোমন, সাইন, কানাডা রাইস, ইন্ডিয়ান রাইস, ওয়াটার ওটস নামে পরিচিত। এর উৎপত্তি স্থল উত্তর আমেরিকায়। কিছু পরিমান চীনে উৎপাদিত হয়।
গাছপালা, ছোট হ্রদ ও ধীর প্রবাহিত স্রোতের মতো পানিতে এদের জন্ম হয়৷ পানিতে থাকা অবস্থায় এর ফলের মাথা ছাড়া সম্পূর্ণ অংশ পানির উপরে থাকে। এতে রয়েছে এমিনো অ্যাসিড, লাইসিন, ডায়টরি, ফাইবার, বেশি পরিমান থাকে৷ সেই তুলনায় ফ্যাটের মাত্রা কম। প্রতি ১০০ গ্রাম ক্যালোরি ও প্রোটিনের ২য় স্থানে রয়েছে এর ওটস। এতে গ্লুটেন নেই। মিনারেল ও ভিটামিন বি এর ভালো উৎস ওয়াইল্ড রাইস। আরো আছে থিয়ামিন, রিবোফ্লাভিন, আয়রন, পটাশিয়াম, নিয়াসিন, ফোলেট, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ।
ওয়াইল্ড রাইস ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে, ওজন কমাতে সাহায্য করে, কোষের মাইট্রোকন্ড্রিকে সুস্থ রাখে, পরিপাকতন্ত্রকে ভালো রাখে, সিলয়াক রোগীদের জন্য এটি উপকারী।
মিলেট(বজরা)
এটি Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্যগুলোর মধ্যে একটা। যা আফ্রিকাসহ এশিয়া জুড়ে বিভিন্ন দেশে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ফাইবার, প্রোটিন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও ফাইটোক্যামিকেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, আরো আছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, অ্যামিনো অ্যাসিড। মিলেট ওজন কমাতে সাহায্য করে, BIM এর মাত্রা ঠিক রাখে। হাই ব্ল্যাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
স্বাস্থ্য উপকারিতা
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে Whole grain(হোল গ্রেইন) শস্য অনেক উপকারি, গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন ২৮ গ্রাম whole grain(হোল গ্রেইন) শস্য খেলে ২২% হৃদরোগ ঝুঁকি কমে যায়, স্টোকের ঝুঁকি কমায়, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। হজমে সাহায্য করে, প্রদাহজনিত সমস্যা হ্রাস করে, ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।