লবস্টার
ক্রাস্টেসিয়ান পরিবারের Nephopdiae (নেফোপডিয়া) সামুদ্রিক প্রাণীর সদস্যদের মধ্যে লবস্টার অন্যতম। এদের রয়েছে পেশিবহুল লেজ(পেট), দীর্ঘ দেহ। সমুদ্রের গভীরের তলদেশের গর্ত বা ফাটলে এদের বসবাস। লবস্টারের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যাক আজ–
বিবরণ
মূলত সারা বিশ্বের মহাসাগরে লবস্টারের বিস্তৃতি রয়েছে। এদের দেহ Exoskeleton (এক্সোস্কেলটন) দ্বারা আবৃত, নখর ও দীর্ঘ লেজ যুক্ত। যা সব কুজিনের একটি জনপ্রিয় খাদ্য। বিভিন্ন প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকান লবস্টার ও ইউরোপীয়ান লবস্টার সবচেয়ে জনপ্রিয়।বিভিন্ন প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। এগুলোর লেজ নখর ও পায়ে মাংস থাকে। যা সফট, মিষ্টি ও সুস্বাদু স্বাদ প্রদান করে। বিভিন্ন খাবারে এর ব্যবহার খাবারকে আরো বেশি মজাদার করে তোলে।
লবস্টারের দেহ সেফালেথোরাক্স নামেও পরিচিত। এটি প্রধানত ২ টি অংশে বিভক্ত থাকে৷ সেফলেন(মাথা) ও থোরাক্স(বক্ষ)।
শরীরের সামনের অংশ হলো সেফলেন। মস্তিষ্ক, চোখ, অ্যান্টিনা ও মুখের অংশ সেফলনের অন্তর্ভুক্ত। শরীরের মাঝখানের অংশ থোরাক্স( বক্ষ) এর অন্তর্ভুক্ত। যা Exoskeleton (এক্সোস্কেলটন) দ্বারা আবৃত থাকে। এই এক্সোস্কেলটন কাইটিন দ্বারা তৈরি হয়। যা একটি শক্ত আবরণ। এটি লবস্টারকে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এক্সোস্কেলটন বৃদ্ধি পায় না। লবস্টার বৃদ্ধির পযার্য়ে এটি molting(মল্টিং) পদ্ধতিতে এক্সোস্কেলটন পরিবর্তন করে। মল্টিং পর্যায়ে এক্সোস্কেলটন শক্ত অবস্থায় না আসা পর্যন্ত লবস্টার দূর্বল থাকে। লবস্টারের দশটি পা থাকে। প্রথম জোড়া বড় নখর। এদের claws (ক্লস) বলা হয়।
এই নখর দিয়ে তারা চলাফেরা করে, খাদ্য গ্রহণ করে ও প্রতিরক্ষায় জন্য ব্যবহার করে। এছাড়া এদের লেজ(পেট) ও প্রতিরক্ষার কাজ করে। এদের দেহের পেছনে পেশীবহুল অঞ্চল সাতারে সাহায্য করে ও পাখার মতো লেজ কাজ করে ফ্লিপারের।
লবস্টারের বৃদ্ধি ও প্রজনন
বাসস্থান ও পরিবেশ– লবস্টার মূলত ২ টি শ্রেণিতে বিভক্ত। ১ টি হলো উষ্ণ পানির লবস্টার অন্যটি ঠান্ডা পানির লবস্টার। ২ শ্রেণির লবস্টারের জন্য পানির তাপমাত্রা ও গুনগত মান বজায় রাখা খুব জরুরি। কারণ পানির গুনগত মান লবস্টারের জন্য সংবেদনশীল। এক্ষেত্রে পরিষ্কার পানি ও অক্সিজেনযুক্ত পানি প্রয়োজন। লবস্টার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। তাই পানির তাপমাত্রা নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ।
লাইফ স্টেজ– ফিমেইল লবস্টার হাজার হাজার ডিম পাড়ে যা বাহ্যিকভাবে রক্ষা করা দরকার হয়। এজন্য পানির অবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লার্ভা পর্যায়– ডিম ফুটে লার্ভা বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে যায়। তখন এদের উপযুক্ত খাদ্যের প্রয়োজন হয়৷ বেঁচে থাকার জন্য পানির গুনগত মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জুভেনাইল পর্যায়– এ সময় লবস্টার বৃদ্ধি পায় ও এদের এক্সোস্কেলটন মল্টিং হয়। তখন এরা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করে। এজন্য এরা শিলা, গুহা বা কৃত্রিম কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে।
লবস্টার আনুমানিক ৪৫–৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এরা প্রায় ১/২ –৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সর্বোচ্চ ৪৪ পাউন্ড ও ৬ আউন্স পর্যন্ত লবস্টার পাওয়া যায়। সারা বিশ্বের মহাসাগরে প্রায় ৭৫ প্রজাতির লবস্টার পাওয়া যায় ( Marine Education Society of Australia- এর তথ্য অনুসারে)। এর মধ্যে ৩০টি প্রজাতি ঠান্ডা পানিতে থাকে। অন্যান্য প্রায় ৪০টি প্রজাতি রয়েছে যারা স্পাইনি/ রক নামেও পরিচিত। এদের নখর থাকে না।
কিছু প্রজাতির লবস্টার সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক
১. হার্ড শেল মেইন লবস্টার–
এটি আমেরিকান লবস্টার নামেও পরিচিত। এরা মিষ্টি ও সফট মাংসের জন্য জনপ্রিয় একটি লবস্টার। মূলত এর দেহ যে পর্যায়ে Molte( মল্টিং) হয় ও এক্সোস্কেলটন শক্ত হতে শুরু করে। এই পর্যায়ে লবস্টারকে হার্ড শেল লবস্টার বলা হয়। এই শক্ত আবরণে কারণে অনেক খাদ্যরসিকদের কাছে কাছে জনপ্রিয়। তারা এই লবস্টারের হার্ড টেক্সচারের স্বাদকে পছন্দ করে। আমেরিকান লবস্টারের ২ টি পর্যায় রয়েছে তার মধ্যে হার্ড শেল একটি। এছাড়া আরো একটি পর্যায় হলো নিউ শেল লবস্টার। মল্টিং এর সময় এক্সোস্কেলটন যখন তৈরি হয় তখন এটি খুব নরম থাকে। এই পর্যায়ের লবস্টারকে নিউ শেল লবস্টার বলা হয়।
খাদ্য রসিকদের কাছে এদের জনপ্রিয়তার মূল বিষয় স্বাদ, টেক্সচার ও ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যতা।
২.কানাডিয়ান লবস্টার–
মেইন লবস্টারের একটি প্রজাতি হল কানাডিয়ান লবস্টার। এরা কানাডিয়ান উপকূলের ঠান্ডা পানিতে বসবাস করে।
এদের খোলস এবং মাংস ঘন হয়। তুলনামূলক সহজলভ্য এই লবস্টার। বসন্তের শেষের দিকে এদের পাওয়া যায়। কানাডার বানিজ্যিক অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. ইউরোপিয়ান লবস্টার –
এই লবস্টার হোমারস, গামারাস ফ্রেঞ্চ, ব্লু ফিস নামেও পরিচিত। ইউরোপের সমুদ্রে এদের সর্বত্র বিস্তৃতি। আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর, আইরিশ সাগর, ভূমধ্যসাগর, বাল্টিক সাগর পর্যন্ত এদের অবস্থান রয়েছে।
এর মাংসের স্বাদ অনেক বেশি হয়। ইউরোপিয়ান কুজিন ও ভোজন রসিকদের কাছে এটি জনপ্রিয়।
৪. ফ্লোরিডা স্পাইনি লবস্টার–
এটি ক্যারিবিয়ান লবস্টার নামেও পরিচিত। এটি উষ্ণ পানির লবস্টার। এদের দেহ কাটাযুক্ত ও নখর নেই। এদের লেজের অংশে মাংস পরিপূর্ণ থাকে। মেইন লবস্টারের মত মিষ্টি বা সূক্ষ্ম গন্ধ নেই এদের। তবে পাস্তা স্যুপের মতো খাবারে এটি খুব সুন্দর স্বাদ যোগ করে। দক্ষিণ ক্যারোলিনা থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি।
৫. ল্যাঙ্গোস্টাইন লবস্টার–
একে Dublin Bay(ডাবলিন বে) ও বলা হয়। লবস্টার এর মধ্যে এটি একটি ছোট প্রজাতি। যা ইউরোপিয়ান কুজিনে জনপ্রিয়। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী খাবার স্ক্যাম্পির বিশেষ উপাদান। নরওয়ে, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডের উত্তর–পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়।
৬. ক্যালিফোর্নিয়া লবস্টার–
ক্যালিফোর্নিয়া লবস্টার উষ্ণ পানির লবস্টার। এদের নখর নেই। এটি একটু সফ্ট, ক্রিমি টেক্সচারের ও বাদামের ফ্লেভারের হয়। চীনের জনপ্রিয় লবস্টার এটি। এছাড়া ক্যালিফোর্নিয়া ও মেক্সিকোর বাণিজ্যিক অংশ এটি।
৭. নিউজিল্যান্ড রক লবস্টার–
এর বৈজ্ঞানিক নাম Jasus edward si(জাসুস এডওয়ার্ড সি)। এরা মাওরি নামেও পরিচিত। এদের ওজন ১০ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। এই ওজন মূলত লেজে থাকে। কারণ উষ্ণ পানির লবস্টারদের নখর থাকে না। এদের নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়াতে পাওয়া যায়। বাটারে ফ্রাই বা গ্রিল করলে এটি খুব সুস্বাদু হয়।
৮.ইস্টার্ন লবস্টার–
এটি নীলচে সবুজ রঙের লাভ স্টার। এর স্বাদ মিষ্টি ও উমামি হয়। বিশ্বের স্বনামধন্য শেফদের কাছে এটি একটি অসাধারণ লবস্টার হিসেবে পরিচিত।
৯.সাউথ আফ্রিকান লবস্টার–
লবস্টারদের মধ্যে এটি একটি সুন্দর প্রজাতি। এদের দেহ কাটাযুক্ত হয় ও নখর থাকেনা। এদের নখর না থাকলেও এরা ঠান্ডা পানির লবস্টার।
সরকারি প্রবিধান অনুযায়ী এদের বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সীমিত পরিমাণ ধরা হয়ে থাকে।
১০.ট্রিস্টান লবস্টার–
সারা বিশ্বের প্রত্যন্ত দ্বীপে Tristan da cunda (ট্রিস্টান ডি কুনহা) লবস্টার পাওয়া যায়। এটি St. Paul Rock Lobster (সেন্ট পল রক লবস্টার) নামেও পরিচিত। অন্যতম ব্যয়বহুল প্রজাতির মধ্যে এটি একটি।
এর স্বাদ মিষ্টি, রসালো ফ্লেভার ও তুলতুলে টেক্সচারের হয়। এরা তুলনামূলক ছোট হয়। এদের গড় ওজন তিন থেকে পাঁচ আউন্সের মত। সর্বোচ্চ ১০আউন্স পর্যন্ত হতে পারে। ট্রিস্টান দ্বীপের বাসিন্দাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই লবস্টার।
১১. চাইনিজ স্পাইনি লবস্টার–
এরা Hongkong Lobster(হংকং লবস্টার)/ Panulirus Stimpsoni(প্যানুলিরাস স্টিমসোনি) নামেও পরিচিত। ছোট প্রজাতির লবস্টারদের মধ্যে চাইনিজ স্পাইনি একটি। এরা উষ্ণ পানির লবস্টার। এর রং সবুজ ও এর মাঝে ছোট ছোট সাদা দাগ রয়েছে। এদের অনেকগুলো মেরুদন্ড থাকে। তাইওয়ান দ্বীপ, ফুজিয়ান গুয়াংডং, গুয়াংসিতে এদের শিকার করা হয়। ছয় ইঞ্চি – এক ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে এরা। কিন্তু সর্বোচ্চ ২০” পর্যন্ত হতে পারে।চাইনিজ কালচারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই লবস্টার।
১২. ওয়েস্টার্ন লবস্টার–
এটি Panulirus Cygnus(প্যানুলিরাস সিগনাস) নামেও পরিচিত এটি। মূলত পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উপকূল অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়। এটি ১১ পাউন্ড এর মত হতে পারে। এদের জীবনী শক্তি ২০ বছর প্রায়।
কিছু তথ্যসূত্র অনুযায়ী সী ফুড এর মোট মূল্যের প্রায় এক– পঞ্চমাংশ এই লবস্টার দখল করে নিয়েছে। ফলে এটি অস্ট্রেলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একক প্রজাতির লবস্টার জাত গুলোর মধ্য একটি। এই লবস্টারের মাংস ক্রিমি ও মিষ্টি ফ্লেভার এর হয়ে থাকে।
মহাসমুদ্রের অতলের অজানা এসকল প্রাণীগুলো আমাদের জীবনে বিভিন্ন ভুমিকা পালন করে। তাই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে আমাদের জানা প্রয়োজন, শেখা প্রয়োজন।