রান্নার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো লবন। যা ছাড়া রান্নার স্বাদের কথা কল্পনা করা যায় না। অতি সাবধানে এর ব্যবহার করা হয়। কারণ পরিমাণে হেরফের হলে স্বাদের বিপত্তি ঘটে যেতে পারে। লবণ শুধু খাবারের নোনতা স্বাদের জন্য নয়। এটি রান্নার অন্যান্য স্বাদও বৃদ্ধি করতে সহায়ক। খাবারের স্বাদ ও টেক্সচার রান্নায় ব্যবহৃত নির্দিষ্ট কিছু লবণ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে,
যা রান্না এবং খাবার সংরক্ষণ উভয়ে ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। এছাড়া খাবারের ফ্লেভার, মিষ্টির এবং তিক্ত স্বাদের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। লবণ অথবা গুণসম্পন্ন সোডিয়াম ক্লোরাইডও সোডিয়ামের জন্য একটি পুষ্টির উৎস হতে পারে, যা শরীরের জন্য আংশিক প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। প্রশ্ন হল কোন লবনটি রান্নার জন্য ভালো এবং সাধারণত কোন লবন রান্নায় বেশি ব্যবহৃত হয়? প্রকার ভেদেও রান্নায় লবণ ব্যবহার হতে পারে। চলুন কয়েক প্রকার লবনের সাথে পরিচিত হই। আর জেনে নেই কোন লবন কোন খাবারের জন্য ব্যবহার করা হয়।
১. কোশের লবণ
কোশের লবণ হল সামুদ্রিক লবন। যা মোটা ও দানাদার এবং এটি অল্প পরিশোধিত। এর বৈচিত্র্য হল এতে প্রায় বিশুদ্ধ সোডিয়াম ক্লোরাইড আছে এবং আয়নাইজড নেই। এই কোশের লবণকে বেকড পণ্য, মাংস, হাঁস-মুরগি এবং সালাদ ছাড়া অন্য যেকোনো কিছুকে সিজনং করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।এই লবণ রক সল্টের উৎস, যা সারা বিশ্বের অসংখ্য দেশে পাওয়া যায়।
২.টেবিল লবণ
প্রচলিত লবন গুলোর মধ্যে টেবিল সল্ট/লবন একটি। রান্নায় ব্যবহৃত সবচেয়ে সাধারণ লবণ এটি। বেশিরভাগ মানুষ একে ডিফল্ট লবণ মনে করে।
তবে, টেবিল লবণ সম্পুর্ণ প্রাকৃতিক লবণ নয়,কারণ এই লবন প্রক্রিয়াজাত করা হয় ও এর খনিজ উপাদান নষ্ট হয়, এতে আয়োডিন এবং অ্যান্টিকেকিং এর মত উপাদান রয়েছে। টেবিল লবন লবনের খনি থেকে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ, এটি রান্নায় ব্যবহৃত অন্যান্য লবনের মত খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ নয়। এই লবন সিজনিং, বিভিন্ন রান্না এবং বেকিং খাবারে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
৩. ফ্লেউর ডি সেল
ফ্লেউর ডি সেল অর্থ হল ‘সমুদ্ররের ফুল’। এই লবন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদানগুলির একটি। কারণ, এটি হাতে তৈরি করতে হয়। এই লবণ তৈরি করার জন্য পুকুর তৈরি করে সংগ্রহ করতে হয়। এই ফ্লেউর ডি সেল লবণটি আসলে ব্রিটানির ফ্রান্সের উপকূল , সমগ্র উত্তর আমেরিকার পাওয়া যায়।
সাধারণত রান্নার শেষে ফিনিশিং বা প্লেটিং এর সময় ব্যবহার করা হয়।
৪. সামুদ্রিক লবণ
মুলত সুদ্রের পানিকে সংরক্ষণ করে জলীয়বাষ্প প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন করা হয়। সাধারণত টেবিল লবণের চেয়ে এই লবনকে কম প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং এতে কিছু পরিমাণ খনিজ উপাদান অবশিষ্ট থাকে।
এর অসম ফ্লেক্সের কারণে, ফিনিশিং কিংবা ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
৫সেল্টিক সী সল্ট
সেল্টিক একটি সামুদ্রিক লবণ। এটি সেল গ্রিস (ধূসর লবণ) নামেও পরিচিত, এটি এক ধরনের সামুদ্রিক লবণ। এটি ফ্রান্সের উপকূলে লবণের সমতলগুলিতে উপস্থিত কাদামাটি থেকে তৈরি করা হয়। এতে প্রাকৃতিকভাবে সুষম খনিজ ও ট্রেস উপাদান থাকে। এই লবন রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
এই লবণটি মসলা তৈরির জন্য খুব ভালো। কারণ, এর একটি হিডেন চঙ্কি টেক্সচার রয়েছে।
৬.সল্ট ফ্লেক্স
রান্নার লবণের একটি যা প্রায়ই বিভিন্ন রেসিপিতে সিজনিং করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই লবণের ক্রিস্টালগুলোকে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে ফ্লেক করে লবণ উৎপন্ন করা হয়। এই ফ্লেকগুলো প্রস্তুতকারকের উপর নির্ভর করে, কারণ এটি সহজ বা অনেক কঠিন প্রক্রিয়া হতে পারে।
সল্ট ফ্লেক বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার হতে পারে। যেমন মাংসের কোশেরিং করা অথবা খাবারকে ক্রাঞ্চি করার জন্য।
৭.পিংক সল্ট
পিংক সল্ট হিমালয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে পাথর থেকে খনন করা লবণের খনি থেকে তৈরি করা হয়। এটি বেশিরভাগ সোডিয়াম,দস্তা এবং আয়রন ও অন্যান্য কিছু ট্রেস উপাদান দিয়ে তৈরি। টেবিল লবণের চেয়ে এটি বেশি আকর্ষণীয় হয়। এছাড়া পিংক সল্ট লবণাক্ত স্বাদের হয়।
সামান্য পরিমান পিংক সল্ট ম্যেরিনেড, ডেকরেশন ও বিভিন্ন সস তৈরিতে অসাধারণ স্বাদ যুক্ত করে।
৮.ব্ল্যাক সল্ট
ব্ল্যাক সল্ট আমাদের দেশে বিট লবন নামে পরিচিত, ইন্ডিয়াতে কালা নামাক নামে পরিচিত।
এটি এক ধরনের শিলা লবণ যা হিমালয়ের আগ্নেয়গিরির শিলা লবণ থেকে সংগ্রহ করা হয়, বেশিরভাগ পাকিস্তানে পাওয়া যায়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম সাথে রয়েছে আরো কয়েকটি ট্রেস উপাদান।
এর তীব্র একটি গন্ধ আছে। খুব সামান্য পরিমান ব্যবহার করা হয় এটি। এটি চমত্কারভাবে স্বাদ বৃদ্ধি করে। এর রয়েছে শক্তিশালী স্বাদ ও সুগন্ধ। যা বিভিন্ন খাবারে যেমন সালাদ, আচার, তরকারি এবং মশলাদার খাবারে অসাধারণ স্বাদ যুক্ত করে।
৯রেড সল্ট/ Alaea salt (আলায়া সল্ট)
রেড সল্ট Alaea salt (আলায়া সল্ট) নামে পরিচিত। যা হাওয়াই দ্বীপের লাল আগ্নেয়গিরির কাদা মাটি দ্বারা তৈরি হয়। এটি হাওয়াইয়ানের একটি লবন। এতে রয়েছে ৪০ টির বেশি খনিজ পদার্থ ও আইয়রন-অক্সাইড সমৃদ্ধ। এটি হাল্কা লবনাক্ত স্বাদের হয় ও সুক্ষ্ম গন্ধযুক্ত থাকে। এটি মাছ, মাংস, মশলা প্রিজার্ভ করতে সাহায্য করে। মুলত খাবারের কালারকে ঠিক রাখতে এই লবন কার্যকারি। সাদা ধরনের খাবারগুলোতে বেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ফ্রাই করার জন্য এটি সহায়ক ভুমিকা পালন করে।
১০. ব্ল্যাক লাভা সল্ট
ব্ল্যাক লাভা সল্ট হাওয়াই ও সাইপ্রাস থেকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর এটি ওই অঞ্চলে পাওয়া লাভা থেকে সক্রিয় কাঠকয়লা দিয়ে ভাজা হয় ফলে লবনের একটি নির্দিষ্ট গাঢ় রঙ তৈরি হয়। এই লবন শরীর পরিষ্কারক হিসাবে কাজ করে এছাড়া হজমের উপকারিতায় সাহায্য করে।
এই লবণ খাবারের উপর ডিজলিং করার জন্য, স্বাদ ও ডেকরেশনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
১১.ব্রিনিং সল্ট
ব্রিনিং সল্ট পানির সাথে মিশিয়ে খাবারে নিজেস্ব একপ্রকার স্বাদযুক্ত করে। এটি খাবারের আর্দ্রতাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। মাংসকে সফট করতে সহায়ক। এই লবনের অন্যতম উদাহরণ হল কোশের সল্ট, সী সল্ট, পিংক সল্ট যেগুলো ব্রিনিং সল্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
১২. ফ্লেভারড সল্ট
খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করতে এবং বিভিন্ন হার্বস অথবা মশলার সাথে ফ্লেভারড সল্ট যুক্ত করে লবণ তৈরি করা হয়। যখন কোন রেসিপি একটু ভিন্ন রকম স্বাদযুক্ত করার প্রয়োজন হয় তখন এটি ব্যবহার করা হয়। এই লবন সামুদ্রিক খাবার, শাকসবজি, , মাছ- মাংসের জন্য ব্যবহার করা করা হয়।
প্রতিটি লবনের স্বাদ, গন্ধ, টেক্সচার ভিন্ন হয়। সেই সাথে ব্যবহারেও রয়েছে পার্থক্য। আপনি আপনার রান্নাঘরে কোন ধরনের লবন ব্যবহার করেন? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।