কিন্তু আপনি শেফদের সম্রাট “একজন সাম্রাজ্যের অধিকারি, একজন সম্পর্কে উপরন্তু উক্তিটি করেছিলেন।” কে সে ব্যাক্তি ?
শুধু কি তাই? বিখ্যাত ফরাসি রান্নার কৌশলগুলো কে সংস্কার করা আর বিখ্যাত Marie Antonin Careme’s এর হাউটে কুজিনকে (Haute Cuisine) পূর্ণগঠন থেকে শুরু করে পৃথিবী বিখ্যাত পাঁচটি মাদার সস (Mother Sauce) সংশোধন থেকে শুরু করে তার দুনিয়া বিখ্যাত কিচেন ব্রিগেড আর এস্কফিয়ার লে গাইড কালিনাইর (Escoffier Le Guide Culinaire) কুকিং বই সহ অনেক বিখ্যাত বই তাঁর অকল্পনীয় অবদান।
এই দুনিয়া বিখ্যাত শেফের নাম জজেস অগাস্টা এস্কফিয়ার (George Auguste Escoffier)।
এটি শুধু নাম না এক আকাশ আবেগ রান্না ভালোবাসা মানুষগুলোর কাছে। রান্না তাঁর রক্তে, হৃদয়ে ধারন করতেন। প্রথম জীবনে উনি একজন ভাস্কর হতে চেয়েছিলেন, যেকোনো ভাবে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি রান্না ঘরে প্রবেশ করে ছিলেন আর ৬২ বছর পর্যন্ত তিনি তার এই খেলার মাঠে ছিলেন, নিজের ইচ্ছে মত রান্না নামক খেলা করে গেছেন। উনার মত কোন শেফ নেই, যিনি এত বছর শেফের জব করেছেন তাই এখনো পর্যন্ত তার শেফ ক্যারিয়ার কে সব থেকে লম্বা শেফ ক্যারিয়ার বলা হয়। এই মহান শেফ ২৮ অক্টোবর, ১৮৪৬ সালে ফ্রান্সের পূর্বে ভিলিনিউভ লুবেতে জন্মগ্রহণ করেন।
যে গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটি এখন মুসি দে ল’আট কুলিনায়ার যেটি এস্কোফিয়ার ফাউন্ডেশন মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তিনি একজন প্রতিশ্রুত ভাস্কর শিল্পী হিসেবে নিজেকে দেখানোর পরও তাঁর বাবা তাকে তার মামার রেস্তোরাঁয় নিয়ে যান। তিনি তের বছর বয়সে তার মামার লে রেস্তোরাঁ ফ্রান্স শেফইস এ কাজ শুরু করেন। সেখানে খাবার তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য কাজও শিখেছেন, কিভাবে সেবা আর সেরা রান্নার সেরা উপাদানটি বাছাই করতে হয়। অল্প সময়ে রান্নায় এত নিজের যোগ্যাতা দেখিয়ে ছিলেন যে নিকটবর্তী হোটেল বেলেভ্যুতে যোগ দেন এর পরে তিনি আরও কয়েকটি রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজ করেন আর ১৮৭০ সালে ২৪ বছর বয়সে তিনি সেনাবাহিনীর কুক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সাত বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করে লে ফ্যাশন ড’ওর( দ্যা গোল্ডেন ফিজ্যান্ট) নামে তিনি নিজের রেস্তোরাঁ খুলেন, যে রেস্তোরাঁ টি খুব অল্পসময়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে অভিজাত ফরাসিদের কাছে।
তিনি ১৮৮০ সালে ডেলফাইন ডেফিসকে বিয়ে করেন পরবর্তীতে সুইজারল্যান্ড এর বিখ্যাত হোটেল রিজ এ কাজ শুরু করেন আর এই হোটেলটি ফ্রান্সে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছিলো। এছাড়া তিনি ১৮৮৪ সালে তার স্ত্রী সহ মন্টে কালোতে চলে যান বিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেল এর রান্না ঘরের দায়িত্ব নিতে, এর পরে লুসানের ন্যাশনাল হোটেল, ১৮৯০ সালে লন্ডনের বিখ্যাত স্যাভয় হোটেল(Savoy Hotel) আর পরে ১৮৯৯ সালে লন্ডনের Carlton এর মত নামকরা হোটেলের রান্নাঘরের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি জার্মান সম্রাট কায়সারের বিশাল অতিথিদের জন্য রান্না করেছিলেন। তাঁর রান্নায় সম্রাট এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে,
তাঁর সাথে দেখা করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তিনি এস্কফিয়ার কে বলেন “আমি জার্মানির সম্রাট, কিন্তু আপনি শেফদের সম্রাট”। এছাড়া তিনি মেসন চেভেট, মেসন মাইরের মত নামজাদা রেস্তোরাঁর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেইসময়ে, তিনি বিখ্যাত গ্রাহদের জন্য পুষ্টি আর রুচি মাথায় রেখে মেনু তৈরি করে দিতেন।
তাঁর অন্যতম বিখ্যাত একটা আবিষ্কার হলো কিচেন ব্রিগেড সিস্টেম। কিচেন কিভাবে চলবে, কিভাবে পরিচালনার স্তর (চেইন অফ কমান্ড) অনুসরণ করতে হবে। একটা সময় কিচেনে উচ্চস্বরে কথা বলা, মারামারি, এমনকি কাজের সময় মদ্যপান একটা সাধারণ ঘটনা ছিলো। কেউ কাউকে মেনে চলতো না, যাকে বলে হযবরল অবস্থা। তিনি বুঝতে পারছিলেন এইভাবে ব্যবসায়িক রান্না ঘর চলতে পারে না, তাই তিনি তার সামরিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কিচেন ব্রিগেড সিস্টেম(সেনাবাহিনীর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে) তৈরি করেন। যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো রান্না ঘরে শৃঙ্খলা আনা, কর্মীদের কে পরিচ্ছন্নতা করা, কাজের পরিবেশ তৈরি করা, একজন কর্মী যেন তার উপরের স্তরের কুকের বা শেফের কথা শোনে।
এস্কফিয়ার লে গাইড কালিনাইর (Escoffier Le Guide Culinaire) প্রকাশ করেন, যা এখনো রান্নার সহায়ক বই হিসেবে রান্নার স্কুল আর প্রফেশনাল শেফরা ব্যবহার করে থাকেন। তার রেসিপি, রান্নার কৌশল আর রান্নাঘরের ব্যবস্থাপনা আজও দুনিয়াজুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এছাড়া A Guide to Modern Culinary ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং আজও খুব সমাদৃত রান্নার বই হিসেবে পরিচিত। এই দুইটা বই আমি আমার MA Culinary Arts Management এর একটা মুডিউল Culinary Artistry তে ব্যাপকভাবে উনাকে আর রেসিপিগুলো নিয়ে কাজ করতে পেরেছিলাম। এই মুডিউলে প্রতিটি রেসিপি এস্কফিয়ার যেভাবে যে উপাদান যতটুকু লিখে গেছেন, ঠিক ততটুকু ব্যবহার করা হতো। যেমন রেসিপিতে যদি বিফ টমেটো থাকতো, সেই একই টমেটো ব্যবহার করা হয়েছে, ফলাফল কেমন আসে তা দেখার জন্য আর ছাত্র- ছাত্রীদের ক্লাসিকাল রান্নার বিষয়গুলো বোঝানোর জন্য।
এই মহান মানুষটি ১২ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৩৫ সালে ৮৮ বছর বয়সে মারা যান। তিনি রেখে দিয়ে গেছেন রান্নার সীমাহীন প্রভাব দুনিয়াজুড়ে। আজও সন্মানের সাথে তাকে আর তার অন্যান্য কৃতিগুলো কে মানুষ মনে রেখেছে আর রাখবে।