বিকাশ খান্না একজন মিশেলিন স্টার প্রাপ্ত ভারতীয় শেফ। পাশাপাশি তিনি একজন ফুড রাইটার, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, ফ্লিম মেকার, স্যোসাল মিডিয়ার জনপ্রিয় মুখ ও মানবিক কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত মানুষ। কলম উঠেছে নতুন এক উদ্যমের কথা নিয়ে। চলুন জেনে নেই বিকাশ খান্না এর রন্ধনশীল্পের যাত্রা সম্পর্কে।
পরিচিতি
বিকাশ খান্না ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন ভারতের অমৃতসরে পাঞ্জাবি পরিবারে। সে জন্মে ছিলো Leg deformity (Club Foot) নিয়ে। তার বাবা ভিডিও ক্যাসেট লাইব্রেরি এর মালিক ছিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় তার একটি অপারেশন করার পরেও তাকে কাঠের জুতা পরতে হতো। যার জন্য তাকে অনেক উপহাসের শিকার হতে হয়েছিলো। সে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত দৌড়াতে পারত না। তিনি অমৃতসরের সেন্ট ফ্রেন্সিস স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। প্রথমে তিনি তার ভাইয়ের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার গণিতে অদক্ষতার কারণে সিদ্ধান্ত বাদ দেয়।
এরপর মণিপাল একাডেমি অফ হায়ার এডুকেশনে স্নাত্মক সম্পন্ন করে হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে ১৯৯১ সালে। তিনি জিডি গোয়েঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মান সূচক ডক্টরেট পেয়েছেন।
রন্ধনশীল্পে অগ্রযাত্রা
পায়ের অসুবিধার কারণে বিকাশ খান্না ঠিক মতো চলাফেরা করতে পারতেন না। এছাড়া কাঠের জুতা পায়ে দেওয়ার জন্য অনেক মানুষের উপহাস তাকে শুনতে হয়েছে। তখন সে পুরো সময়টা তার দাদীর সাথে রান্না ঘরে কাটিয়েছেন। পাঞ্জাবের পরিবেশ প্রকৃতি, টাটকা মৌসুমী ফসল, পারিবারিক খাদ্যরস ও দাদীর হাতের ট্রডিশনাল রান্না এর মধ্যে থেকে তার বেড়ে ওঠা। এসবের মধ্যেই সে রান্নার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তার দাদীর থেকেই সে রান্নার হাতেখড়ি পান। তখন থেকেই সে ভারতীয় রান্না সম্পর্কে জানতে শুরু করেন ও রান্নার প্রতি তার আবেগ আগ্রহ জাগ্রত হয়। ১৭ বছর বয়সে তিনি Lawrence Gardens এ নিজেস্ব বেনকোয়েট ও ক্যাটারিং ব্যবসায় শুরু করেন।
তখন তিনি Welcomegroup Graduate School Of Hotel Ambassador থেকে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে স্নাতক সম্পন্ন করেন। সে সময়ে বিকাশ তাজ গ্রুপ অফ হোটেল, ওবেরয়স, লীলা গ্রুপ কাজ করেছেন ও অনেক বিখ্যাত গুনী শেফদের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
ক্যারিয়ার
তার মনে আরো বড় স্বপ্ন গড়ে উঠেছিল। সে চেয়েছিলো একজন বিশ্ব স্বীকৃত শেফ হওয়ার। তাই সে পাড়ি জমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেছেন Culinary Institute Of America, Cornell University ও New York University তে এরপর প্যারিসের মর্যাদাপূর্ণ Le Cordon Bleu তে পড়াশোনা করেছেন। নিউইয়র্কে তিনি আমেরিকার সবচেয়ে সন্মানীয় শেফদের সাথে কাজ করেছেন। তিনি প্রেস থেকে তার গ্যাস্ট্রোমোনিক সহকর্মীদের অনেক ভালো প্রশংসা পেয়েছেন পরবর্তীতে তিনি নিউইয়র্কের Salaam Bombay ও The Cafe at the Rubin Museum Of Art এ কাজ করেন।
তারপর তিনি যোগ দেন ম্যানহাটনের ফ্ল্যাটিরনে একটি আপস্কেল ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট Junoon এ। যে বছর তিনি Junoon জয়েন করেন সে বছর The New York Times এ Sam Sifton এর থেকে প্রশংসিত হন ও ২০১১ সাল থেকে একটানা ৬ বছর তিনি মিশেলিন গাইড হতে মিশেলিন স্টার অর্জন করেন।
গর্ডন রামসি (Gordon Ramsay), এরিক রিপোর্ট, ববি ফ্লে ও জিন-জর্জেস ভঙ্গেরিচটেন সহ অনেক শীর্ষ স্থানীয় শেফদের সান্নিধ্যে কাজ করেছেন বিকাশ। জি ডি গোয়েঙ্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অফ ফিলোসফি (Honoris Causa) ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
এছাড়া জেমস বিয়ার্ড ফাউন্ডেশন থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
তিনি ডি ওয়াই পাতিল ইউনিভার্সিটি থেকে সাহিত্য ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
SATH থেকে Access to Freedom Award পেয়েছে ২০০৫ সালে।
তিনি Deutsche Welle New and Gazette এর রিভিউ হতে বিশ্বের সেরা ১০ শেফের একজন হিসেবে স্বীকৃত হয়।
২০১১ সালে আমেরিকান কুজিনের ভবিষ্যত গঠনে ভূমিকার জন্য বিকাশকে স্টার শেফদের দ্বারা ‘Rising Star’ শেফ এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
People Magazine থেকে Sexiest Man Alive তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন নভেম্বর ২০১১ সালে।
২০১২ সালে তিনি GQ Magazine হতে GQ India Man of the year হয়েছিলেন।শহরে তার অসামান্য অবদানের জন্য নিউইয়র্কের নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল থেকে এ্যানাউন্স করা হয় ও NY1 হতে New year of the week নির্বাচন করা হয়েছিলো যা Health India Magazine এর কভারে প্রদর্শিত হয় ২০১২ সালে।
তার বই Return to the Rivers ২০১৪ সালে James Beard Foundation Award এ পুরুষ্কারের জন্য নমিনেশন পায়।
Just One Break, Incorporate থেকে The Shining Star এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
New York’s Hottest Chef হিসেবে নির্বাচিত হন New York Eater blog হতে পরিচালিত ভোটে।
দুবাইতে তিনি Kinara নামে একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন ২০১৯ সালে। এরপর সেখানে Ellora নামে আরো একটি রেস্টুরেন্টে খোনেল ২০২০ সালে।
মিডিয়া ও সামাজিক কর্মকান্ড
বিকাশ মাস্টার শেফ ইন্ডিয়াতে মূল ব্রিটিশ সংস্করণের উপর ভিত্তি করে ২-৮ পর্যন্ত সাতটি সিজনে হোস্টিং করেন। এরপর থেকে সে চলমান সব সিজনেই হোস্টিং করছেন।
তাকে মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়াতে বিচারক হিসেবে সিজন৬-এ আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।ফক্স লাইফের টুইস্ট অফ টক শো এর ৪ টি সিজনের হোস্ট ছিলেন। গর্ডন রামসে টিভি সিরিজে Kitchen Nightmeres Purnima নামে একটি ব্যার্থ ভারতীয় রেস্টুরেন্টকে সাহায্য করতে তাকে পরামর্শক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। Hell’s Kitchen এর ২ টি সিরিজে তিনি বিচারক ও ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন। থ্রোডাউনে আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। ববি ফ্লে তে বিচারক ছিলেন, দ্যা মার্থা স্টুয়ার্ট শো তে তিনি গেস্ট শেফ হিসেবে ছিলেন।
তিনি একজন মানবতাবাদী মানুষ।
মানুষের জন্য সে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিকাশ south Asian Infinite Vison (SAKIV) নামে একটি ফাউন্ডেশন চালু করেন। সেখানে তিনি সুনামি ত্রাণ, হারিকেনস অফ দ্যা গল্ফ কোস্ট, হাইতির মতো দূর্যোগ সমস্যার জন্য কাজ করেছেন। দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন Save The Children এর সাথে সহযোগী হিসেবে ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী অনেক অনুষ্ঠান অর্গানাইজ করেছেন মিশরের গিজার গ্রেট পিরামিড হতে ভারতের তাজমহল পর্যন্ত। আলমা মাদার ওয়েলকাম গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ হোটেলে তিনি প্রথম কুলিনারি মিউজিয়াম অফ ইন্ডিয়া তৈরি করেছিলেন ২০১৮ সালে। ২০০১ সালে নিউইয়র্কে তিনি বিশ্বের শীর্ষ শেফদের সাথে বিভিন্ন সামাজিকিকরণ কাজের জন্য কুকিং ফর লাইফ প্রতিষ্ঠা করেন।
তার পুরস্কার প্রাপ্ত কর্মশালা ভিশন অফ প্যালেট যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাদ, গন্ধ ও সুগন্ধি অনুভব করার সম্পর্কে শিক্ষার জন্য তৈরি করা করেছেন। নিউইয়র্ক সিটির রুবিন মিউজিয়াম অফ আর্ট এ প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য আয়োজিত একটি তহবিল সংগ্রহের জন্য রান্না করেছিলেন ২০১২ সালের ১৪ মে। Smule foundation এবং Malnutrition in India এর জন্য তিনি ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বৈশ্বিক মহামারী COVID-19, ২০২০ এর এপ্রিলে ফিড ইন্ডিয়া উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এটি পেপসি ইন্ডিয়া গেট, কোয়াকার ওটস,, হায়াত রিজেন্সি ও বিধবাদের জন্য গ্লোবাল ফান্ড থেকে সমর্থিত ও ভারতের অভাবীদেরকে খাদ্য সরবারহ করা হয়েছিল।
তিনি রন্ধন শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি একজন লেখক। তিনি ৩০ টিরও বেশি বই লিখেছেন। তার মাস্টার পিস বই UTSAV, ১২০০ পৃষ্টার এই বইতে তিনি তুলে ধরেছেন ঐতিহ্য ও উৎসব সম্পর্কে, হাতে আঁকা-ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী, Gold gilded কপি যা ব্যক্তিগতভাবে বারাক ওবামা, পোপ ফ্রান্সিস, দালাই লাম ও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তার বই বরাইড সিডস এর উপর ভিত্তি করে অমৃতসরের একটি ক্লাব ফুট আক্রান্ত শিশু কিভাবে আমেরিকাতে আসে এবং শূন্য থেকে কিভাবে সফল হয় ও ম্যানহাটন রেস্টুরেন্ট থেকে কিভাবে নিজেকে তুলে ধরে বিশ্বদরবারে এ নিয়ে আন্দ্রেই সেভের্নি পরিচালিত চলচিত্র নির্মান করা হয়। বইটির নামেই চলচিত্রের নামকরণ করা হয়েছিলো। বিকাশ খান্না তার লেখা বইগুলো বিশ্বের সবচেয়ে দামী বই হিসেবে নিলাম করা হয়েছিল এবং যার নির্মাতা ছিল Holy kitchens ও Kitchens series of documentaries
তার বই সমুহ
আয়ুর্বেদ- দ্যা সায়েন্স অফ ফুড এন্ড লাইফ; ম্যাঙ্গ মিয়া- সেলিব্রেটিং দ্যা ট্রপিক্যাল ওয়ার্ল্ড অফ ম্যাঙ্গস; দ্যা কুজিন অফ গান্ধী-বেইসড অন দ্যা বিলিফস অফ দ্যা লিজেন্ড; দ্যা স্পাইস স্টোরি অফ ইন্ডিয়া; মর্ডান ইন্ডিয়ান কুকিং, ফ্লেভার ফার্স্ট: এ্যান ইন্ডিয়ান শেফস জার্নি; মাই গ্রেড কুক বুক; খান্না সূত্রা:ফুড লেসনস ইন লাভ; এভরিওয়ান ক্যান কুক; সোরাভ মুম্বাই: এ কালিনারি জার্নি থ্র ইন্ডিয়াস মেল্টিং পট; ইয়াং শেফস; রিটার্ন টু দ্যা রিভার্স: রেসিপিস এন্ড মেমোরিস অফ দ্যা হিমালয়ান রিভার ভ্যালিস; ব্লিস অফ স্পাইস- দ্য এসেন্স অফ ইন্ডিয়া কিচেন; হিমেস ফরম দ্যা সয়েল- এ ভেজিটেরিয়ান সাগা; অমৃতসর- ফ্লেভারস অফ দ্যা গোল্ডেন সিটি; দ্যা ম্যাজিক রোলিং পিন;
ওয়ার্ল্ড ফেস্ট- মাই ফেভারিট কিচেন; মাস্টার শেফ ইন্ডিয়া কুক বুক; শেকেন এন্ড স্ট্রিড-101নন-এ্যালকহোলিক ব্লেন্ডস; টাইমলেস লেগেসি- হিজস হলনেস দ্যা ডালি লামা; দ্যা মিল্ক মাস্টাস; উৎসব- এ কালিনারি এপিক অফ ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যাল;
ইন্ডিয়ান হার্ভেস্ট-ক্ল্যাসিক কনটেম্পোরারি ভেজিটেরিয়ান ডিসেস;এসেন্স অফ সিজনিং- মাই অল টাইম ফেভারিট রেসিপি; মকটাইলস, পান্সস এন্ড সোর্ভাস;মাই ফার্স্ট কিচেন; এ ট্রি নেমড গঙ্গা; পাত্রা- হ্যারিটেজ অফ দ্যা ইন্ডিয়ান কিচেন; দ্যা লাস্ট কালার, দ্যা হোলসাম গ্রাইন; প্লিগমাস ফ্লেভার্স; স্রিমনি অফ এ্যারোমাস; ম্যাজিক অফ শো কুকিং; বারকাত; স্কারেড ফুডস অফ ইন্ডিয়া; বেরফুট ইম্প্রেস; ইমাজিনারি রেইন।