আমার একবার বামিংহাম এর লাসান (LASAN) রেস্টুরেন্ট এ ট্রায়াল শিফট দিতে হয়েছে জবের জন্য। যদিও এইটা একটা বাংলাদেশি মালিকানাধীন ফাইন ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। সেই জবটা আমার হয়ে যায় তবে জবটি আমি করিনি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বলে কারণ আমার কাজ কন্টিনেন্টাল এর উপর। পরে অবশ্য তাদের মালিকানাধীন Estado da India তে জব হয় যেটি Portuguese স্টাইল এর ফুড পরিবেশন করে। দুই সপ্তাহ করে ছেড়ে দিয়েছি জবটা। আমার Dissertation Supervisor এর সাথে জবের ব্যাপারে আলোচনা করাতে, উনি আমাকে OPHEEM এ আবেদন করতে বলে আর বলেছেন শেফ আকতার আমার বন্ধু আমি বলে দিবো বা তুমি আমার কথা বলিও। এই LASAN রেস্টুরেন্ট থেকে শেফ আকতার ইসলাম এর উঠে আসা। তারপর নিজে OPHEEM খুলে উনি নিজেকে সবার কাছে পরিচিতি তৈরি করেছেন উনার মেধা আর যোগ্যাতা দিয়ে।
OPHEEM এর অবস্থান এমন জায়গায় যাকে বলা যায় আমার ইউনিভার্সিটির মাঝখানে মানে স্যান্ডউইচ এর মত। ইউনিভার্সিটির প্রধান ক্যাম্পাস সামাররো থেকে লিংক আর মেক্লেন্টার হাউস এ এই তিন মিনিট এর রাস্তায় অপেহাম। চোখের সামনে রেস্টুরেন্টার উদ্ভোদন তার মিশেলিন পাওয়া আর শেফের ফেসবুকে থাকা এক নগন্য আমি।
প্রথনে, শেফ আকতার ইসলাম যিনি মিশেলিন স্টারড এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত রেস্টুরেন্টের মালিক ও উদ্যোক্তা। তার প্যাশন, আগ্রহ, সৃজনশীলতা তাকে এনে দিয়েছে অসাধারণ সাফল্য। তিনি তার মেধা ও পরিশ্রমের কারণে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত।
গ্রেড ব্রিটেনে তিনি বিষেশভাবে খ্যাতি লাভ করেছেন। তার রন্ধনশীল্পে প্রবেশ ও সফলতার পেছনের গল্পগুলো নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। সে সকল বিষয়ে আজ আমরা জানব।
পরিচিতি
১৯৭০ দশকের শেষের এক বাংলাদেশী দম্পতি ব্রিটেনে আসেন। সেই পরিবারে ১৯৮০ সালে জন্ম হয় আকতার ইসলাম এর।
আকতার ইসলাম তার বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্য দ্বিতীয়। তার বাবা সিরাজ ছিলেন বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী। আকতার ইসলাম আস্টন(Aston) শহরে বেড়ে উঠেছেন। বর্তমানে তার বয়স ৪০+। তার একজন পুত্র সন্তান রয়েছে নাম এ্যালেক্স। আকতার ইসলাম এর বাবা মা নম্র, কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। তার পরিবার বার্মিংহামের বাসিন্দা হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তার বাবা শার্লি সোলিহুলে দ্যা ইন্ডিয়ান প্যালেস নামে সাধারন একটি রেস্টুরেন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেন। ১৩ বছর বয়স থেকে আকতার ইসলাম তার বাবার প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শুরু করেন।
রন্ধনশীল্পে যাত্রা
খুব ছোট থেকেই রান্নার সাথে তার সম্পৃক্ততা। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকে তিনি তার মায়ের সাথে রান্না করতেন। মুলত মায়ের বাড়ির রান্না থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রান্নার প্রতি আবেগ, ঐতিহ্যবাহী খাবারের আধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার করার মাধ্যমে স্বাদের সন্ধান করতেন। সেই আবেগ আর অনুপ্রেরণা থেকেই তার রন্ধনশীল্পে প্রবেশ এবং সে সিদ্ধন্ত নেন তিনি একজন সেরা শেফ হিসেবে নিজেকে তৈরি করবেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবার দ্যা ইন্ডিয়ান প্যালেসে প্রথেম কাজ শুরু করেন। কলেজে থাকাকালীন সময়ে বার্মিংহামে Shimlapinks(সিমলাপিঙ্কস) এ কাজ করতেন। ১৬ বছর বয়স থেকে স্কুল ছেড়ে বাবার প্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ সময় কাজ শুরু করেন।
১৮ বছর বয়সে একটি ইতালীয় রেস্টুরেন্টে জব করেন সেখান থেকে তিনি ইতালীয়ান রান্না সম্পর্কে অনেক ভাল ধারনা লাভ করেন। যা তার ক্যারিয়ারে দারুণ প্রভাব ফেলে। তখন তিনি বুঝেছিলেন ইতালীয়ান রান্না ও ভারতীয় রান্নার পার্থক্য। সেখানে ২ বছর কাজ করার পরে আবার বাবার রেস্টুরেন্ট দ্যা ইন্ডিয়ান প্যালেসে ফিরে আসে তখন তার বয়স ২০ বছর। সে সময়ে তিনি রেস্টুরেন্টটি নিজ দায়িত্বে পরিচালনা করতেন ও রেস্টুরেন্টটির নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় কর্ম(KARMA)। ২ বছর কঠোর পরিশ্রমের পরে তাদের রেস্টুরেন্টটি প্রথমবারের মত লাভ জনক ব্যবসায় হিসেবে পরিণত হয়।
ক্যারিয়ার
২০০৭ সাল এ সময়ে আকতার ইসলামের বয়স ২২ বছর। তখন তিনি জব্বার খানের সাথে St Paul’s Square, Jewellery Quarter ও বার্মিংহামে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট লাসান(LASAN) প্রতিষ্ঠা করে। লাসান গ্রুপে তিনি প্রধান শেফের ও পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। একই সালে warwick University Medical School এর সহযোগিতায় একত্রিত হয়ে তার কুকিং বুক ও ডিভিডি চালু করেছিলেন। যার নাম Spice of Life। এই লাসান থেকেই আকতার ইসলামের জীবনের সফলতার অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
২০০৯ সালে আকতার ইসলাম ও Sous Chef আয়সান শেখ চ্যানেল 4 এর গর্ডন রমসে থেকে The F Word এ Santa Maria(সাউথ আমেরিকান কুজিন), Sweet Mandarin(চাইনিজ কুজিন) কে হারিয়ে লাসানকে “সেরা স্থানীয় ভারতীয় রেস্টুরেন্ট” ক্যাটাগরিতে Cheltenham থেকে Curry Corner কে পরাজিত করে সেমিফাইনালে যান। এরপর তারা Keyston থেকে The Pheasant কে পরাজিত করে সমগ্র ফাইনালে জয়ী হন। ২০১১ সালের জুনে আকতার ইসলাম বিবিসি টু সিরিজের গ্রেট ব্রিটিশ মেনুর সেমিফাইনালে সেন্ট্রাল রিজিওনাল হিট জিতেছিলেন। ফাইনালে ফিস কোর্স জয় লাভ করে।
বিভিন্ন টিভি শো এর মধ্যে মার্কেট কিচেন, পারফেক্ট স্যাটারডে কিচেন, দ্যা ওয়ান শো এর মত টিভি শো তে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি সাউথ এশিয়ান শেফ কম্পিটিশনের একজন নিয়মিত জাজ হিসেবে নিয়জিত। বিভিন্ন সেলিব্রিটি শেফদের নিয়ে গুড ফুড শো, অটাম ফেয়ার, হট অফ ইংল্যান্ড ফাইন ফুডস, ফুড অ্যান্ড ড্রিংক এক্সপো, Taste ফ্যেস্টিব্যেল, গ্র্যান্ড ডিজাইন লাইভ ও শ্যারন অসবোর্নের মিসেস ওসবোর্ন প্রেজেন্টস এ অংশগ্রহণ করেন।
২০১২ সালে জব্বার খান এবং অ্যান্ডরু ক্লিনথাউসের সাথে Restaurant Angels চালু করেন, এটি হসপিটালিটি ও কনসালটেন্সি সার্ভিস দিয়ে থাকে যা ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল রেস্টুরেন্টগুলো দিয়ে থাকে। ২০১২ এর ডিসেম্বরে তিনি বার্মিংহামের এজবাস্টনে একটি আর্জেন্টিনার আসাডো রেস্টুরেন্ট ফিয়েস্তা দেল আসাদো চালু করে যেখানে প্রথম নন-এশিয়ান ফুড নিয়ে কাজ করে।
২০১২ সালের মে মাসে আকতার ইসলামকে আইসিসি তে বার্মিংহাম ইয়াং প্রফেশনাল অফ দ্যা ইয়ার নির্বাচিত করা হয়। উদ্যোক্তা বিভাগে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি সামগ্রিক শিরোপা জয় করেছিলেন।
ব্রিটিশ হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিতে অবদানের জন্য তাকে বাকিংহাম প্যালেসে এটি সংবর্ধনাতে যোগ দেওয়ার জন্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের অক্টোবরে তিনি বার্মিংহামের হল গ্রীনে Raja Monky (এর পাশে আমি তিনমাস একটা নতুন সীফুড এর কাজ শুরু করেছিলাম কিন্তু হঠাৎ মালিক তার একসাথে কেনা ৫ টি রেস্টুরেন্টকে পিজ্জা রেস্টুরেন্ট বানানোর প্ল্যান করাতে আমি জবটা ছেড়ে দিয়ে লন্ডন চলে আসি। প্রোপার ফ্রান্স এর একটা চেইন যেটি বিখ্যাত MAYFAIR এরিয়াতে অবস্থিত ও জবটা হয় আমার হেড অফিস ফ্রান্স থেকে। যাদের ১৮ টা রেস্টুরেন্ট আছে দুনিয়ার সব সেরা জায়গায় আর ইংল্যান্ড এ একটা) নামে একটি ভারতীয় ধাবা চালু করেন। আকতার ইসলাম মার্কেটিং বার্মিংহাম বাইটস ক্যাম্পেইনে শহরে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন নিজের উদ্যোগে কিছু করতে।
এ জন্য ২০১৭ সালে লাসান গ্রুপ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং তার ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট ওফিম(OPHEEM) প্রতিষ্ঠা করেন। সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১৮ এর মে তে চালু হয় ওফিম (OPHEEM)। আকতার ইসলাম প্রগতীশীল ভারতীয় ও বাংলাদেশি রান্নাকে আধুনিকতার সাথে ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে এক নতুনত্ব এনেছিলেন ওফিম(OPHEEM) এ। ১ বছরের মধ্যে ২০১৯ এর অক্টোবরে আকতার ইসলাম প্রথম ব্রিটিশ জন্মগ্রহনকারী বাংলাদেশী শেফ ও ওফিমকে(OPHEEM) ফার্স্ট মেশেলিন স্টার পুরষ্কৃত করা হয়। কারণ ওফিম(OPHEEM) লন্ডনের বাইরে একমাত্র প্রথম মেশেলিন স্টারড ভারতীয়/বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট।
ওফিম(OPHEEM) একটি আধুনিক ওপেন প্ল্যান কিচেন। যার মুল ডাইনিং রুমের ভিউ একটি সুন্দর বার ও পার্সোনাল ডাইনিং পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তিতে ২০১৮ তে তিনি Legna চালু করেন।
২০২০ এর মার্চ মাসে ব্রিন্ডলি প্লেস, বার্মিংহামে আর্জেন্টিনীয় স্টেক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে Pulperia চালু করার কথা ছিল। নানা প্রতিকুলতা থেকে সৃজনশীলতা কিভাবে তৈরি হয় তার প্রমান মিলে শেফ আকতার ইসলাম এর মাধ্যমে। ২০২০ সালের করোনা কালীন সময়ে একটি মেশেলিন রেস্টুরেন্টের মানসম্পন্ন খাবারগুলো ফ্রোজেন হওয়া সত্বেও যুক্ত্রাজ্যের যেকোনো জায়গাতে খাবার পাঠানোর এবং পুনরায় গরম করার উপায় তৈরি করে তা সরবারহ করার প্রক্রিয়া সত্যি অনেক কঠোর বিষয় হওয়া পরেও তা করে দেখিয়েছেন তিনি। সে সময় তিনি চালু করেন আকতার এ্যাট হোম। তার এই পরিষেবাটি সকল মিশেলিন স্টারড শেফরা প্রশংসা করেছিলেন।
জাতীয় প্রেস ও সাধারন জনগন সাপোর্ট করেছিলেন ও প্রশংসা করেছিলেন। ২০২১ সালে বার্মিংহামে এজবাস্টানে আরো একটি রেস্টুরেন্ট চালু করার কথা ছিল।
তিনি বার্মিংহাম চিলড্রেনস হসপিটাল, এনএইচএস ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি স্পাইস ফর লাইফ ক্যাম্পেইন সহ দাতব্য সংস্থাগুলোর সমর্থনকারী।