আমি বিশ্বাস করি মানুষ তার স্বপ্ন সমান বড়। স্বপ্ন বাস্তবায়নের বড় হাতিয়ার মনোভাব, মানসিকতা তার সাথে দরকার সঠিক দিক নির্দেশনা।
আমি আবু সালেহ। আমার ফ্যামিলিতে আমি সহ ৩ ভাই ১ বোন ও বাবা-মা আছে। আমি ভাইদের মধ্যে মেজো। নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মতো আমার অন্য আর দশটা গ্রামের ছেলের মতোই বেড়ে ওঠা। ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি গ্রামেই বড় হয়েছি। বর্তমানে আমি ইউনাইটেড হসপিটালে কমি-১ হিসেবে কাজ করছি। যদিও আমার এই পথচলা এতটা সহজ ছিল না। আজ আমি লিখব আমার এই পথ চলার বিস্তারিত।
সালটা ২০১৬ এর শেষের দিকে। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছি। আমার বাবা চাকরির সুবাদে বিদেশ থাকতেন। তার কিছুদিন পর আমার রেজাল্ট প্রকাশ হল। আমি অনার্স ভর্তির জন্য বিভিন্ন কলেজে ভর্তির আবেদন শুরু করি। এক পর্যায়ে ওই বছর আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। তখন আমার এক ভাই আমাকে বলল তার বাসার পাশে মহাখালী আমতলিতে একটা কলেজ আছে। এটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তবে তুলনামূলক খরচ কম। এখানে ভর্তি হলে সাথে কিছু করলে বাসা থেকে আর টাকা আনতে হবে না। তাই ২০১৭ সালে আমি সেখানে ভর্তি হয়ে যাই। এখান থেকে শুরু হলো আমার নতুন জীবন মেস লাইফ।
প্রতিমাসে আমার থাকা-খাওয়া, কলেজ ফি-সহ ১০হাজার টাকা লাগতো। যা আমার বাড়ি থেকে আনতে হতো। বিষয়টা আমার অনেক খারাপ লাগতো। গ্রামের বাড়ি হতে অনেক সময় অনেক কথা শুনতে হয়েছে। বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেছি কিছু করার কিন্তু হয়ে ওঠেনি। আবার আমি যে মেসে থাকতাম সেখানে সকাল ও রাতের খাবার রান্না করা হতো। কারণ সবাই ছিল চাকরিজীবী আমি শুধু স্টুডেন্ট। তাই দুপুরে অনেক সময় আমার খাবার নিয়ে কষ্ট করতে হতো। এর মধ্যে আমার বাবা বিদেশের কাজের পরিবেশ + অসুস্থতা + অনেকদিন বিদেশ থেকে আসার জন্য বলছে। তখন আমার সেমিস্টার শেষ হয়েছে মাত্র ১ টা। আমার কলেজে থাকা অবস্থায় কিছু করাও সম্ভব ছিল না ক্লাস এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, কঠিন সাবজেক্ট থাকার কারণে। এজন্য বাবা বিদেশ থেকে আসার পরে আমার পক্ষে পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল না। কারণ গ্রাম থেকে দশ হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব না, তাছাড়া এখানে পড়ার পর কি হবে তাও নিশ্চিত না এটা ছিল প্রফেশনাল কোর্স। তাই ২০১৭ এর শেষে আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন করি সেই সময় ১ম মেরিট লিস্টে আমার সুযোগ হয়। তখন আমি প্রাইভেট ভার্সিটি ছেড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই।
ঢাকা না ছাড়া জন্য আমি এক ভাইয়ের রেফারেন্সে মার্কেটিং রিপ্রেজেনটিভ হিসেবে যোগ দেই। এখানে আমি সব ভালো করার পরও এই পেশায় নিজেকে ভালো লাগছিল না। কারণ অনেক সময় দোকানদারদের ব্যবহার + পণ্য কম চলার পেছনে আমি তেমন কিছু করতে পারছিলাম না। কোম্পানির সবাই আমার চেষ্টা দেখে আমার ওপর খুশি যদিও। আমি নতুন কিছু খুঁজছিলাম। যেখানে আমি আমার নিজের মেধা ও জ্ঞান কাজে লাগাতে পারবো অন্যের সহযোগিতা ছাড়া। যেহেতু আমার কোন লোক নেই যে আমাকে ভালো জব দেবে বা হেল্প করবে। আমি এমন কিছু চেয়েছি যেখানে আমি থাকব কোন কোম্পানির সম্পদ।
যাতে কেউ আমাকে হারাতে চাইবে না এবং আমি যা পারবো অন্য সবাইকে দিয়ে হবে না। এজন্য আমি এমন কিছুই খুঁজছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম মেকানিক রিলেটেড গাড়ি ঠিক করা এই নিয়ে এগোবো। কারণ, কেউ চাইলেও সহজে গাড়ি ঠিক করতে পারেনা। তারপর আবার ভাবলাম যারা গাড়ি চালায় ওদের ব্যবহারও বেশি ভালো থাকে না, সেখানকার পরিবেশও তেমন ভালো হয় না। একদিন বিকেলে চিন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক রুমমেট বড় ভাইয়ের সাথে মেলাতে গিয়ে শুনলাম ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি মেলা। সেখানে বিভিন্ন হোটেল, এয়ারলাইন্সের কোম্পানি, বিভিন্ন স্টল বসেছে। ওই সময় ওদের চলাফেরা ও কথা বলা সবকিছুই আমার ভালো লাগে কিছু শেফরাও ছিল সেখানে।
ওখান থেকে আসার পর আমি এটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। যেমন আমি যখন বাড়িতে ছিলাম আমার ছোট বোনকে শেখানোর জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কিছু রান্না করতাম। যা আমার কাছে ভালো লাগতো। ঠিক যেমনটা দেখতাম তেমনটাই ডেলিভারি করতে পারতাম। যা অন্যরা খেয়ে ভালো বলতো। বিষয়টি আমার কাছে অনেক ভালো লাগতো। এমনকি আমার মা অনেক ভাল রান্না করে। অনেক সময় লক্ষ্য করতাম, আমার কাকি জেঠি তাদের বিভিন্ন রান্নায় আলাদা আলাদা টেস্ট বা স্বাদ থাকে। এসব ভেবে আমি ভাবলাম এটা দিয়েও তো আমি আমার সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারি এবং আমি যা পারবো তা অন্য সবাই পারবেনা। আমার ছোট থেকে ঘোরার অনেক শখ ছিল, ঘুরতে ভাল লাগতো। এই পেশায় আসলে আমি ঘুরতে পারবো দেশে-বিদেশে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর ভবিষ্যতে চাইলে আমি নিজেও কিছু করতে পারবো আলাদাভাবে। তখন আমি আবার ভাবতে শুরু করলাম আমার এক মামা সেই সময় শেফ ছিল। তার কম্পিউটারে কিছু খাবারের ছবি ও বিভিন্ন ফল সবজি সুন্দর কার্ভিং করে ফুল ও ফল সাজানো ছিল, যা দেখে আমি অবাক হতাম। খুব ভালো লাগতো দেখতে। সেই কথা ভেবে মামাকে কল দিলাম এবং সে বলল এই পেশায় যত অভিজ্ঞতা হবে তত সম্মান বেশি। যে ভাই আমাকে ঢাকা নিয়ে এসেছে তার সাথে কথা বললাম। সেও মামার মত বলল এটা খারাপ না। সেই সময় আমি ওই চাকরিটা করছিলাম। আর বাবাও বাড়ি চলে এসেছে, আমিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়ে গেলাম। আর এইদিকে ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে তথ্যের জন্য আসলাম। কিন্তু সেই সময় এখানে ভর্তি সময় শেষ, অপেক্ষা করতে হবে ৬ মাস। আমি খোঁজা শুরু করলাম অনলাইনে। খুঁজে পেলাম ঢাকা সাভারে, কথা হলো কাগজপত্র ম্যানেজ করে নিয়ে চলে গেলাম।
অফিসে বলে চাকরি ছেড়ে যোগ দিলাম সেখানে। যাদের সাথে ভর্তি হয়েছি আমি তাদের সবার থেকে ছোট ছিলাম। শিক্ষাগত যোগ্যতায়ও এরা এগিয়েছিল। শুরু হল আমার যাত্রা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। বাড়ি থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিলাম। যেহেতু আমি চাকরি করি ও আমার কিছু টাকা ছিল তা দিয়েই আমি চলতে পারবো, ভালোই চলছিল। এদিক দিয়ে আবার আমার কলেজে পরীক্ষা, সব কোনরকম ম্যানেজ করলাম কোর্সে মনোযোগ দিলাম বেশি। আমাদের ক্লাস নিতেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ম্যাম, তার হাত ধরে বাংলাদেশে অনেকে শেফ হয়েছে। ম্যামের নাম মেরিনা খন্দকার, তিনি বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের এফএমবি এর প্রধান ছিলেন।
তার সাথে আরও কিছু নামকরা শিক্ষক ছিলেন এর মধ্যে আনোয়ার স্যার একজন, যাকে অনেকে চেনে। তারা অনেক চেষ্টা করেছে এই বেসিকটা ভালো করে শেখানোর জন্য। তারা চেষ্টা করেছিল ভালো কিছু দেখানোর এবং শেখানোর। ওখানে প্র্যাকটিক্যাল ও থিওরিক্যাল ক্লাস নিয়েছিল ৫ মাস। আমার ব্যক্তিগতমতে ক্লাস ও বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন ছিল। দেখতে দেখতে আমার কোর্স শেষ এবার ইন্টার্নি। আমার ইচ্ছে ছিল হোটেলে ইন্টার্নি করার। কিন্তু আমার ইন্টার্নি পড়েছে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে, বিমান ফ্রাইড ক্যাটারিং এ তিন মাসের জন্য। সেখানে বুচার, ভেজিটেবল, হট কিচেন, কোল্ড কিচেন, পেস্ট্রি কিচেন সব কিচেনেই কাজ করেছি। চেষ্টা করেছি কাজ থেকে শেখার জন্য। অনেক শেফ কাজ শিখিয়েছে সহজে, আবার অনেকে প্রথমে শেখাতে চাইনি। লেগে থেকেছি তাদের কাজে সাহায্য করেছি তারা সাহায্য না চাইলেও, এক সময় তারা শিখিয়েছে। অনেক সময় অনেক শেফকে না বুঝে ভুল জাজমেন্ট করেছি। ভেবেছি লোকটা মনে হয় ভালো না বা ব্যবহার খারাপ। কিন্তু পরবর্তীতে তার সাথে মিশে বুঝতে পেরেছি আমার ধারণা ভুল ছিল। আসলে সেই মানুষটি মন থেকে অনেক ভাল ছিল ও ভালো পরামর্শ দিত। অনেক শেফ আছে যারা কাজে ফাঁকি দেওয়া দেখতে পারেনা, তাই সব সময় চেষ্টা করেছি কাজে লেগে থাকার। দরকার হলে বলেছি শেফ একটু রেস্ট দরকার বা এটা বুঝিনি অথবা আপনার কথাটি সঠিক বুঝিনি। কারণ এখানে জবে ঢুকে বুঝতে পেরেছি কাজের জায়গায় প্রোপার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক দরকারি। অনেক সময় মন খারাপ থাকত এটার জন্য যে, তারা বলত ওকে দিয়ে হবে না, ও পারবেনা, ও বোঝে না। আবার অনেকে অনেক প্রশংসাও করেছে, এতে কাজে মনোযোগ ও আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। চেয়েছি যেন তার এই বলার মর্যাদা রাখতে পারি। আমি বুচার সেকশনে বেশি কাজ করেছি। সেখানে সবাই অনেক ভালো ছিল ও সহজে আমি অনেক কাজ ধরে নিয়েছিলাম। তাই তারা অনেক সময় আমার ওপর অনেক কাজ ছেড়ে দিতেন। যা আমার দায়িত্ববোধ আরো বৃদ্ধি করত এবং আমি সব কাজ সাহস নিয়ে করার চেষ্টা করতাম। এ কারণে ছাত্র হিসেবে আমি অল্প দিনে সেখানে ভালো মাছ কাঁটতে পারতাম। বিমানে ফিশ স্টেক, ফিস ফিঙ্গারসহ অনেক মাছের খাবার যায় ও অনেক বড় বড় মাছ আসতো। তাই শেফরা আমাকে ডেকে নিয়ে যেত মাছ কাঁটার জন্য। সেখানে ছাত্রদের মাছ ধরা নিষেধ ছিল কারণ ছাত্ররা এই দামি মাছ নষ্ট করে ফেলতে পারে। আমি সেই সুযোগ পাওয়ায় মনে হয় এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। আবার অনেকে অনেক বার ভুল জাজমেন্ট করত আমাকে। আমি বিষয়টি সহজ ভাবে নেওয়ার চেষ্টা করতাম, অন্যদের দ্বারা বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করতাম বা সরি বলতাম।
দেখতে দেখতে আমার ইন্টার্নি প্রায় শেষের দিকে। আবার আমি অস্থির ছিলাম যদি ইন্টার্নি শেষ হওয়ার আগে চাকরি না পাই আমাকে বাড়িতে চলে যেতে হবে। বাড়ি চলে গেলে চাকরি পাওয়া যাবে না ঢাকায়ও আসা হবে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের ইন্টারের পর বাড়ি থেকে অনেক প্রেসার দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমস্যা, বিভিন্ন কথা শুনতে হয়। বাড়ি থেকে টাকা চাইতে লজ্জা লাগে। এর মধ্যে আমার সাথে যে ছিল ওর বিমানের কোন এক শেফের মাধ্যমে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি হয়ে যায়। এ কথা শুনে আমার পরিবার আমাকে বলে ওর চাকরি হয়েছে তোর চাকরি হয় না কেন। ওই ছেলে সম্পর্কে আমার ভাগিনা হয়।
তাকে আমি আমার সাথে নিয়ে এসেছিলাম। তার নানু, নানা, মা আমার ফ্যামিলিকে বলে যে ও ভালো পড়াশোনা করেছে ও কাজ করেছে তাই তার শেফ তাকে দেখে চাকরি দিয়েছে। আমার পরিবারও আমাকে সে নিয়ে কথা শোনাতো। আমি তাতে মোটেও ভেঙ্গে পরিনি। আমি এটা জানতাম আল্লাহ তা’আলা আমার জন্য হয়তো বা আরো ভালো কিছু রেখেছেন। এখনে আমি পড়াশোনা ও কাজ কোনটাই কম করিনি। সেটা ওই ছেলেও জানে আমার স্ট্রাগল সম্পর্কে, আমার চেষ্টা সম্পর্কে। তাই আমি শুরু করলাম আমার চাকরি যোগাড় করতে। যেভাবেই হোক চাকরি আমাকে পেতেই হবে। তখন আমার ডিউটি ছিল দুপুর দুইটা থেকে। তাই আমি সকাল সকাল উঠে অনেকগুলো সিভি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে জিজ্ঞাস করতাম তাদের লোক লাগবে কিনা। এভাবে উত্তরা, বনানী, গুলশান সব জায়গার ছোট বড় সব রেস্টুরেন্টে সিভি দিলাম। যাদের লোক লাগবে না তাদেরও সিভি দিয়ে আসলাম যখন লাগবে তখন যেন আমাকে জানায়। প্রায় ৫০-৬০টা সিভি বিলি করলাম।
হঠাৎ এক রেস্টুরেন্টে গেলাম বললাম যে চাকরির কোন পজিশন খালি আছে কিনা। তখন সেখানকার কিছু লোক আমার সাথে মশকরা করল বলল বেতন কম ডিউটি অনেক আপনি করতে পারবেননা ১৪-১৫ ঘন্টা ডিউটি। আমি বললাম আমি পারবো তখন তারা বলল না ভাই লাগবে না, আর এভাবে তো জব পাবেন না এক্সপেরিয়েন্স ছাড়া। এক কাজ করেন ওই জায়গায় একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হচ্ছে ওখানে গিয়ে দেখতে পারেন। সেখানে যাওয়ার পর একজন বলল লোক তো নেওয়া হয়ে গেছে যেহেতু এসেছেন সিভি দিয়ে যান আমি এইচআরকে এ জমা দিয়ে দেব। সেখানে সিভি দিয়ে আমি চলে এসেছি, আর জানা মতে কোন জায়গা বাকি রাখিনি যে দেওয়া যাবে।
তার মধ্যে ডিসেম্বরের ১ তারিখ একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কল আসলো, আমি তো মহা খুশি আমার ইন্টার্নি শেষ ১৯ তারিখে। তখন আমি গেলাম উত্তরায় ওই রেস্টুরেন্টে, গিয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বললাম। সে আমাকে বলল থাকা খাওয়া কোম্পানির বেতন ৫০০০ টাকাব+ সার্ভিস চার্জ, যেহেতু নতুন তাই তাদের সাথে দুই বছরের চুক্তিতে যেতে হবে দুই বছরের মধ্যে আমি জব ছাড়তে পারবো না। আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি, দুই টা বছর অনেক সময় তাই ডিসাইড করতে আমি সময় নিলাম দুই দিন বলেছি জানাবো। আর অপেক্ষা করতে থাকলাম ইন্টারভিউয়ের। দেখতে দেখতে আমার ইন্টার্নি শেষ হয়ে গেল। কোন কল আসলো না। তখন আমি ঠিক করলাম যদি ইন্টার্নি শেষ হয়ে যায় তাহলে টাকা দিয়ে থাকা খাওয়া সম্ভব না। তাই এটাতে ঢুকে যাই কি আর করার। ২০ তারিখ তাদের ওখানে গিয়েছি তখন তারা বলল লোক নেওয়া হয়ে গেছে এখন লাগবে না। বলল ২৫ তারিখ আসেন স্যারের সাথে কথা বলে দেখি। তখন ২৫ তারিখ যাওয়ার পরে বলল এখানে তোমার সাথের একজন জয়েন করেছে। এখন পজিশন খালি নেই তুমি চাইলে ওয়েটারে জয়েন করতে পারো। পরে খালি হলে কিচেনে দিয়ে দেব। যদি রাজি থাকো তাহলে আজকে থেকেই শুরু করো। আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম এখন যদি সময় নেই এটাও আর পাব না। তখন আর কি করবো রাজি হয়ে গেলাম। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ সেখানে জয়েন করার পর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন ঝামেলা। ১২-১৪ ঘন্টা ডিউটি, হল থেকে কোন সময় বাইরে যাওয়া যাবে না, কারো সাথে কথা বলা যাবে না, মোবাইল ধরা যাবে না, কাজ না থাকলেও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যেদিক থেকে গেস্ট প্রবেশ করে সেখানে দাঁড়িয়ে ওয়েট করা তাছাড়া পানিশমেন্ট তো আছেই। স্টাফদের খাবারের অবস্থা ও পরিবেশ তেমন ভালো ছিল না। এছাড়া বেতন নিয়ে বিভিন্ন কারণ দেখাতো। ২৮ তারিখ সকালে বলছে ৩০ তারিখ জাতীয় নির্বাচন কারো ছুটি লাগলে নিতে পারো। আমি না করলাম। দুপুরে খাবারের জন্য ছাদে গিয়েছিলাম তখন বানানী থেকে একটা কল আসে- ইন্টারভিউ আছে কালকে আসতে পারবেন? তখন আমি সেখানে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যাই। নিচে গিয়ে আমি ছুটি নেই। পরের দিন বনানী এসে কল দিয়ে লোকেশন কনফার্ম করলাম। দেখি সেই রেস্টুরেন্ট যেখানে আমি লাস্ট সিভি জমা দিয়েছিলাম। আগে থেকে ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে লোক কনফার্ম হয়ে গিয়েছিল এখন আবার নতুন করে ওদের ইন্টারভিউ নিচ্ছে প্রধান শেফ ও ম্যানেজমেন্ট। তারা ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন শুনেছি। এটা ইন্ডিয়ান একটি রেস্টুরেন্টের গ্রুপ রেস্টুরেন্ট বাংলাদেশের চেইন এনেছে নামকরা একটি কোম্পানি। রেস্টুরেন্টের নাম ”মেইনল্যান্ড চায়না” যা ওই সময় ফাইন ডাইনিং বলা হত অনেক পপুলার ও এক্সপেন্সিভ ছিল। ইন্দো-চাইনিজ, জাপানিজ ফিউশন কুকিং ছিল এই রেস্টুরেন্টের। ডেকোরেশন ও কিচেন ইকুইপমেন্ট ছিল অসাধারণ আমি যেখানে জব করতাম তার থেকে অনেক গুণ ভালো। লাকিলি এখানে আমার ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম চাকরি হলেই হল সুন্দর জায়গার তারপর তো ওখান থেকে বাঁচা যাবে। এরপর ইন্টারভিউ শুরু হল। আমাকে নিজের সম্পর্কে বলতে বলেছে বলেছি, তারপর কাটিং নিয়ে, তাপমাত্রা নিয়ে, ফিস কাটিং নিয়ে, মাদার সস কি কি পারি তা আর ওই সময় আমি ভাল কার্ভিং করতে পারতাম তাও বলেছি। তখন তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করল তুমি কত চাও। আমি ১২হাজার টাকা চাইলাম পজিশন কমি-৩। তারা আর কিছু বলল না। বলল ৭ তারিখ এসে ড্রেসের মাপ দিয়ে যেতে পারবা? আমি কিছুটা অবাক হলাম কোন বার্গেডিং করল না, জব কি হয়েছে না আগের মত ইন্টারভিউ নিয়ে আবার বাতিল করে দেয় তা ভাবতে লাগলাম। আবার একটা ভরসাও পেলাম। যাই হোক দিন গুনতে থাকলাম আর ওইখানে চাকরি করতে থাকলাম কষ্ট করে সব সয়ে। আবার বাসা ছেড়ে দিতে হলো যেহেতু আমার মাস শেষ তখন ওই বড় ভাইয়ের বাসায় উঠে যাই। আর ৭ তারিখের অপেক্ষায় ডিউটি করতে থাকলাম। ৭ তারিখ কল দিয়ে ১৩ তারিখ জয়েন করতে বলল। ১৩ তারিখ পর্যন্ত ডিউটি করলাম আগের রেস্টুরেন্টে বিনা টাকায়। তারপর ভালোভাবে বলে চলে আসলাম। জয়েন করলাম নতুন জায়গায়, স্বপ্ন সত্যি হলো। এখানে অনেক ভালো ও সুন্দর পরিবেশ। এমনকি আমার ভাগিনার রেস্টুরেন্টের থেকেও অনেক ভালো। স্যালারিও খারাপ না।
তারপর তিন মাস আমাদের অন্য এক রেস্টুরেন্ট এর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হলো। ভালোভাবে ট্রেনিং শেষ হলো। রেস্টুরেন্ট ওপেনিং-এর সময় সবাইকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছিল। তখন কমি-২ আর ১ দের এক একটা সেকশন এর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছিল। তখন ফ্রাই সেকশনে লোক সর্ট। কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ শেফ বলল কে পারবে? আমি বললাম আমি পারবো আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। কারণ আমি ট্রেনিংয়ে ফ্রাই সেকশনেও কাজ করেছি। ট্রেনিং এর সেই রেস্টুরেন্টের শেফ কে কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করল উনি পজিটিভ ফিডব্যাক দিয়েছে। তাই আমাকে ফ্রাই সেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হল। আমি কমি-২ তে কাজ করতে লাগলাম। প্রথমে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল হাত অনেক জায়গায় পুড়ে গিয়েছিল তাও কাউকে বুঝতে দেইনি। তবে আমি থেমে থাকি নি যে যে সমস্যা হচ্ছিল তা শেফের কাছে জিজ্ঞাসা করে শিখে নিয়েছি। আমি একটি বইয়ে পড়েছিলাম অজ্ঞ হওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নেই কিন্তু সঠিক পদ্ধতি আয়ত্ত করার অনিচ্ছা প্রকৃতই লজ্জাজনক। আমাকে সেকশন দেওয়াতে অনেকে আমার পেছনে লেগেছিল। ওরা সাত আট বছর কাজ করে ডিশ ওয়াস/টুয়াড থেকে কাজ শিখেছে। কমিস-২ এর দায়িত্ব আমাকে কেন দিল শেফ তার জন্য। যদিও আমি কাগজে-কলমে পাইনি তাও। আমার সাথে যারা কাজ করছিল তাদের একটা গ্রুপ ছিল আগে থেকেই। একসাথে সব জব করেছে সবাই ডিশওয়াশ থেকে কাজ শিখে এসেছে। তাদের বাড়ি ছিল একসাথে সবাই সবার আত্মীয় বা পরিচিত। আমি এসব দেখে বুঝেও না বোঝার ভান করতাম। সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। পরে অনেকেই বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে নিলেও দুই তিন জন নিতে পারেনি। তারা সব সময় আমাকে গাইড করার চেষ্টা করত আমার দোষ ধরার চেষ্টা করত। এসব কিছুই শেফ অবজার্ভ করতো। তিনি আমাকে যথেষ্ট ভালো জানত বলতো আমি সব দেখি। আমি থাকতে কোন সমস্যা নেই। ওই দুই এক জন তাদের কাজগুলো আমাকে ধরতে দিত না শেখার জন্য গেলে তারা কাজ বন্ধ করে দিত। আবার কোন কাজ করে দিলে বলতো ঠিক হয়নি এছাড়া অন্যরকম তাদের মুখের এক্সপেশন ছিল, এগুলো আমি বুঝতে পারতাম। আমি ফ্রাই সেকশনে কাজ করার জন্য রাইস, নুডুলস সেকশন, মেইনকোর্স খাবার গুলো দেখতাম আর ট্রাই করতাম। অনেক সময় মেনু লিখে রাখতাম যা এখন অনেক কাজে আসে। ওই দুষ্টু লোকগুলোর জন্য আমি ডিমসাম, সুশি, নাগিরি, সাশিমি এই খাবারগুলো ভালোভাবে দেখতে পারিনি। ওগুলো শিখতে পারলে আমি আরো বেটার কিছু করতে পারতাম যা পরবর্তীতে আমি রিয়েলাইজ করতে পারছি। যে লোকগুলো এমন করেছে তাদের অবস্থা এখনো পরিবর্তন করতে পারিনি। আলহামদুলিল্লাহ আমি ওদের থেকে ভালো আছি।
তার কিছুদিন পর আমি রেস্টুরেন্ট থেকে ২ মাসের ছুটিতে গিয়েছিলাম পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। আগে পরীক্ষা শেষ হওয়ায় আমি লা মেরিডিয়ানে অন কলে কাজ শুরু করি এক শেফের মাধ্যমে। শেফ আমাকে কন্টিনিউ করার জন্য বলেছিল বাট আমি টাকা আর ছুটির কথা ভেবে ও তখন সময় শেষে আবার ওই রেস্টুরেন্টে জবে ঢুকি। তার কিছুদিন পর লা মেরিডিয়ান থেকে অনকলের জন্য কল আসে শেফ বলে একটু কষ্ট করে হলেও আসো। তখন রেস্টুরেন্টের এক্সিকিউটিভ শেফ ছুটিতে দেশের বাইরে ছিল। তাই ওই সব লোকদের কাছে দায়িত্ব দিয়ে যায় আর আমি ছুটি চাইলে অনেক কথা শুনায়। আমাকে ছুটি দেবে না তারা চাইলে ছুটি দিতে পারতো। এমনকি হাফ বেলা ছুটি ও তারা কনসিডার করবে না। কোন কথাই শুনবে না তারা। তাই তাদের আমি বিকালে আসবো বলে চলে গিয়েছিলাম। বিকালে আসার পর তারা আমাকে কাজে যোগ দিতে দেয়নি। এর পাঁচ দিন পর শেফ এসে আমাকে কাজে যোগ দিতে দিয়েছে এবং আমাকে বুঝিয়েছে। পরে আমি বুঝতে পেরেছি জোর দেখিয়ে যাওয়াটা আমার ঠিক হয়নি। এইভাবে ১.৩ মাস কেটে গেল শুরু হলো করোনা ভাইরাস। এজন্য রেস্টুরেন্টটা বন্ধ হয়ে গেল। করোনা মাঝে আমি চার মাস বাসায় ছিলাম। এরপর আমার জেলা শহরের ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টের দায়িত্বে ছিলাম ২০ সিটের একটি রেস্টুরেন্ট। এখানে প্রায় সাত মাস কাজ করার পর ঢাকাতে করোনার মধ্যে একটা ক্লাউড কিচেন থেকে ইন্টারভিউ কল আসে। ক্লাউড কিচেনটির নাম লাহোরে বাই আইকিচেন। এটি আইকিচেন লিমিটেডের ব্র্যান্ড। মূলত তারা করোনার মধ্যে অনলাইনে ডেলিভারির মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিল। সেখানকার শেফ ছিল পাকিস্তানের লাহোরের। এখানে খাবার আইটেমের মধ্যে ছিল পাকিস্তানি কাবাব ও কারি বিরিয়ানি যা ঢাকার মধ্যে অনেক জনপ্রিয়। আমি সেখানে কমি শেফ হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। নতুন রেস্টুরেন্ট থাকায় চার মাস কোন ছুটি পাইনি একদিনও। সেলও খুব ভালো ছিল, যাইহোক সবাই সমবয়সী ছিলাম সবার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এরপর আরো দুইটা ব্রেন্ড শুরু হল। লেবানিস ফুড ও এরাবিক ফুড আর বাঙালি ফুডও। অল্প দিনে সব কাজ ধরে নিলাম। পাকিস্তানি শেফ ও চলে গেল করোনাও কমা শুরু হল। সেলের পরিমাণও কমে যাচ্ছিল (এখানে থাকা অবস্থায় আমার বাংলাদেশী ইয়াং শেফ মইনুল এর সাথে পরিচয় হয়। তাকে সবাই বাঙালি শেফ হিসেবে চেনে। উনি ইন্টার কন্টিনেন্টাল, লা মেরেডিয়ান সহ ভালো ভালো হোটেলের লিডিং পজিশনে ছিলেন। আই কিচেনে এক্সিকিউটিভ হিসেবে জয়েন করেন। তিনি অনেক ভালো মনের একজন মানুষ আমাকে অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেন। আমাকে ডিসিশন নিতে হেল্প করেন সব সময়। আমিও তার সাথে সবকিছু শেয়ার করি)। দিন দিন কাজ করতে করতে আমি ফুড ও এই পেশার উপর অন্যরকম একটা টান অনুভব করতে পারি। যেমন এই পেশার লোকদের সাথে আমার সহজেই সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় এবং তাদের সাথে সময় কাটানো, লং টাইম কথা বলা আড্ডা দেওয়া ভালো লাগতো। দশ মাস পর আবার একটি ইন্টারভিউ আসলো ইউনাইটেড হসপিটালে। ৪৫০ বেডের হাসপিটাল এটি। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের হসপিটাল সেক্টর ভালো হসপিটাল এর মধ্যে এক বা দুই নাম্বারে থাকবে। যাই হোক ইন্টারভিউ দিলাম প্রধান শেফ জেবিয়ারের কাছে। উনি বাইরে দেশে ১২-১৪ বছর থেকে লা মেরিডিয়ানে সু শেফ হিসেবে ছিলেন। সেখানে তিনি আমাকে হাইজেন ও খাবার নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। এরপর এখানে জবটা হয়ে গেল আমি আমার পড়াশোনা ও ছুটি ছাটা ইত্যাদি বিষয়ে জানিয়ে জবে ঢুকে গেলাম।
যে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি তার থেকে হসপিটাল অনেকটা ভিন্ন এখানে তেমন কোন নতুন খাবার দেখা যায় না আর প্লেটিং এ নতুনত্ব নেই তাই এখানে শেখার সুযোগও কম। এখানে বাঙ্গালী ফুড, চাইনিজ ফুড, সামান্য কিছু কন্টিনেন্টাল সালাদ, ফাস্টফুড নির্দিষ্ট একটা মেনু এটাই চলে। তাছাড়া বিভিন্ন রিকোয়ারমেন্টে কম ঝাল, ঝাল ছাড়া, লবণ ছাড়া খাবার থাকে। তবে কাজের প্রেসার থাকায় ১০-১১ ঘন্টা একাধারে কাজ করতে হয়। এখন আমি যেকোনো চাপ/প্রেসার হ্যান্ডেল করতে পারি খুব সহজেই। তাছাড়া এখন অনেক বিশাল কোয়ান্টিটির খাবার রান্না করি। ২০০-২৫০ জন লোকের খাবার রান্না করা আমার কাছে কোন ব্যাপার মনে হয় না। এই চাকরিটা আমি ছাড়তে পারিনি কারণ আমার পড়াশোনা বিবিএ সেই সময়েও চলছে। আর এখান থেকে আমি সহজে অনেক ছুটি পাই পরীক্ষার জন্য। কিছুদিন আগে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছি এক হোটেলে। সেখানকার শেফ আমার লিংকডিংন এ ছিল। সে আমাকে আবেদন করতে বলে। এরপর ইন্টারভিউ হয়। ডকুমেন্টস চাইলে বলে দরকার নেই আমি আছি তুমি জয়েন করো। হসপিটালে রিজাইন দিয়ে দেও। আমি রিজাইন দিয়ে দিলাম জয়েন করার ৫-৬ দিন আগে। তখন সে আমাকে বলে একটু সমস্যা হয়েছে তুমি দু এক দুই মাস পরে জয়েন কর। এখন তুমি অন্য জায়গায় একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করতে থাকো আমি তোমাকে পরে নিয়ে আসবো। তখন আমার হসপিটালের শেফ শুনে আমার রিজাইন তুলে নিয়েছে আর আমি এখন পর্যন্ত ইউনাইটেডে আছি। তার পাশাপাশি আমি আমার গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। রেজাল্টও দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। তারপর অনেকদিন তেমন কোন আবেদন করিনি। তিন চার মাস যাবত আবেদন করছি নামকরা কিছু প্রতিষ্ঠানে। দেশে চার-পাঁচটা ও দেশের বাইরে চার-পাঁচটা ইন্টারভিউ দিয়েছি। কিন্তু ভালো কিছু করতে পারছি না। কিছু করতে না পারার কারণ আমার মনে হচ্ছে যুগের সাথে নিজেকে আপডেট না করা, যথাযথ ফুড রেসিপি শেখার অভাব, এই সময় আমার ফুড নিয়ে যা শেখার দরকার ছিল তা শিখতে না পারা ও সঠিক জায়গা থেকে সঠিক মানুষের কাছ থেকে সঠিক কিছু না শেখা, কমিউনিকেশন এর অভাবে নিজেকে গুছিয়ে তুলে ধরার অভাব, ভাষাগত দুর্বলতা ইত্যাদি। এর মধ্যে আমি নিজেও অনেকটা ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম। এই প্রফেশন নিয়ে আমার ভুল ধারণা বাড়ছিল। সঠিক গাইডলাইনের অভাব অনুভব করছিলাম। আগে থেকেই শুনছি এই পেশা সমুদ্রের মতো বিশাল কিন্তু কখনো দেখিনি বা শুনিনি আর নিজের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ঘুরছিল। এর সমাধান নিয়ে কার কাছে যাব ক্লিয়ার ধারণা পাচ্ছিলাম না। এমন কাউকে খুঁজছিলাম যে এই প্রফেশন নিয়ে ক্লিয়ার ধারণা দেবে ও আমাকে লক্ষ্য দেখাবে।
বেশ কিছুদিন আগে একটা কাজে আমি কক্সবাজার গিয়েছি। দিনটি ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩। যেতে যেতে রাত ১.৩০ এ পৌঁছালাম। মোবাইল ধরতে চোখের সামনে একটা ফুডের ছবি ভেসে উঠলো সিকুয়েন্স সহকারে গোছানো কিছু লেখা। যেহেতু ফুডের উপর আলাদা একটা টান ছিল তাই পড়তে লাগলাম। কিছু লাইন পড়ার পর আমাকে যেন বাকিগুলো পড়ার জন্য খুব টানছিল। সেই ভদ্রলোকটার পেইজের নাম ছিল শেফ জেভিয়ার। এমন সুন্দর গোছানো লেখা এই হসপিটালিটি প্রফেশনে আমি কখনো দেখিনি। এই মানুষটার লেখার মধ্যে কিছু অদৃশ্য শক্তি আছে। আমি আলাদা একটা শক্তি পেলাম আর পেইজের ভেতর ঢুকে বাকি লেখা গুলো দেখলাম অসাধারণ। আমি অনেক লেকচার ও কুকিং নিয়ে বেশ কিছু বই পড়েছি যখনই সামনে কুকিং বা খাবারের কোন বই দেখতাম তা সংগ্রহ করার চেষ্টা করতাম। সেই বইগুলো হতে আমার এমনটাই চাওয়া ছিল। অনেক সেমিনার অনেক কিছুতে গিয়েছি এমন সুন্দর করে আগে কেউ বলেনি আর এই বিষয়গুলো তুলে ধরেনি। লেখাগুলোর মধ্যে কুকিং নিয়ে অনেক বিশালতা ছিল আমার দেখা ও জানা কুকিং নিয়ে এমন সব তথ্য আগে কখনো দেখিনি এমনকি এভাবে ভাবিওনি। আমি যা খুঁজছিলাম তার থেকেও অনেক বিশাল কিছু ছিল এটা। রাত ৪ টা পর্যন্ত অগোছালোভাবে পড়লাম। ফলো দিয়ে রাখলাম বাকিগুলো পড়বো বলে। লেখাগুলো আমাকে সব সময় টানছিল। এর আগে আমি মাস্টারশেফ নাজিম খান ছাড়া কোন শেফকে ফলো করিনি। তখন ভাবতে থাকলাম এমন শেফ বাংলাদেশের কোথায় আছে। বাংলাদেশে থাকলে তো আগে থেকে অবশ্যই জানতে পারতাম উনার এই অসাধারণ ট্যালেন্ট সম্পর্কে।
যে করেই হোক তার সম্পর্কে জানার অনেক কৌতুহল আমার বৃদ্ধি পেতে থাকল। পোস্টগুলো পড়ে বুঝতে পারলাম উনি দেশের বাইরে থাকেন। রান্না নিয়ে তার এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা। এই রন্ধন পেশায় তার অনেক সেক্রিফাইসের কথা, অনেক সংগ্রামের কথা বলা ছিল। যা আমাকে রীতিমতো আবেগতাড়িত করে তোলে। এছাড়া আরও জানতে পারি এই পেশাতে তার অনেক বড় বড় একাধিক পড়াশোনা ও ডিগ্রী আছে। তার এই শেখার জার্নি টাও অনেক লম্বা অনেক সংগ্রামে ছিল। এই পথটা তার জন্য মসৃণ ছিল না। বিভিন্ন প্রতিকুলতা পাড় করে তার আজকের এই অবস্থান। ভালো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পড়াশোনা। আমি তার পোস্টগুলো খুঁজে বের করে এক একটা করে পড়ি ও সনাক্ত করার জন্য লাইক ও কমেন্ট করে রাখি। যেন কোনটা মিস না করি। চেষ্টা করি কোন লেখা মিস না করার, পোস্টগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমি নোট করে রাখার চেষ্টা করি। এরপর প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম। যতই পড়ি কুকিং এর প্রতি আগ্রহ, ভালোবাসা ও টান তত বেশি অনুভব করতে পারি। ভেতর থেকে কেন যেন আলাদা রান্নার প্রতি ইম্প্রেশন কাজ করে তখন আমার লক্ষ্য বড় হতে থাকে। সব সময় নতুন নতুন কিছু নতুন ভাবে জানতে পারি যা আগে এইভাবে কখনো ভাবিনি। আমি যে শুনতাম কুকিং সমুদ্রের মত বিশাল তা এখন বুঝতে পারি। ভেতর থেকে একটা জিনিস কাজ করত যে আমি মনে হয় অনেক কিছু জানি, কিন্তু এখন শেফের পোস্ট পড়ে ও তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারছি আমি এতদিন কুকিং নামক সমুদ্রের কিছুই শিখতে পারিনি। যা শেখাটা আমার দরকার ছিল। এই পেশা কতটা যে বিশাল তা এখন অনুভব করতে পারি। এই পেশাকে এখন হৃদয় থেকে অন্তর থেকে ধারণ করার চেষ্টা করি। কুকিং এখন আমার আবেগ আর অনুভূতির জায়গা হয়ে উঠেছে। যতই শেফের লেখা পড়ি ও তার সাথে কথা বলি নিজেকে নতুন ভাবে জানতে পারি আরো জানার পিপাসা বাড়তে থাকে। আমার গন্তব্য এখন অনেক দূর। নতুনভাবে স্বপ্ন দেখি একদিন আকাশ ছোঁয়ার। ইনশাল্লাহ একদিন মুক্ত আকাশে উড়ে আকাশ ছুঁবো। আমি মনে করি ও আমি বিশ্বাস করি আমি পারবো। আল্লাহ তা’য়ালা যেন আমাকে পরিশ্রম করার শক্তি দেয় ইনশাআল্লাহ। বর্তমানে আমি নতুন একটি চেইন হোটেলে কমি-১ হিসেবে চাকরি পেয়েছি। আর শেফ জেভিয়ার এর নির্দেশনা ও গাইডলাইন অনুযায়ী নিজেকে ডেভেলপ (উন্নত) করার চেষ্টা করছি। স্বপ্ন এখন আকাশ ছোঁয়ার সাথে আছে প্রিয় মেন্টর/শেফ জেভিয়ার। ধন্যবাদ প্রিয় শেফ আপনার ছায়ায় আমাকে স্থান দেওয়ার জন্য। কৃতজ্ঞতা প্রিয় মেন্টর প্রিয় শিক্ষক আপনার মূল্যবান সময়, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। প্রতিদানে কিছুই দিতে পারব না কখনো এক বুক কৃতজ্ঞতা ছাড়া। আজকের আমি ও এক বছর আগের আমি কখনো এক নই। যদি কখনো সম্ভব হয় আমি তার সাথে অবশ্যই সাক্ষাৎ করব ইনশাআল্লাহ। এই মানুষটার সাথে আরো আগে পরিচয় হওয়া উচিত ছিল। জেভিয়ার শেফ এর সাথে আমার পরিচয় হয়তো বা অল্পদিনের। কিন্তু যতটুকু বুঝতে পারছি তার মত মানুষ হয় না। তার চিন্তা ভাবনা কত সুন্দর, কুকিং এর প্রতি তার ভালোবাসা ও সেক্রিফাইস, কালিনারি জ্ঞান, নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার যে মন মানসিকতা, নিজের সময় মেধা দিয়ে অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মনোভাব এসব কিছুই আমাকে বিমোহিত ও অবাক করে। জেভিয়ার শেফের মত কিছু ট্যালেন্টেড মানুষ যদি বাংলাদেশের সব পেশাতে পাওয়া যেত তাহলে নতুন জেনারেশন ধন্য হতো। তার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে আমার অজানা কিন্তু শেফ জেভিয়ার একজন অসাধারণ মানুষ। আমি সবসময় এই মানুষটার জন্য দোয়া করি যেন সুস্থ থাকে হাসিখুশি থাকে। তার থেকে আমাদের নতুনদের অনেক কিছু নেওয়ার আছে।
মানুষের জীবনেও এ কথা সত্য। আমাদের ভেতরে কি আছে সেটাই প্রধান। আমাদের ভেতরের যে জিনিসটি আমাদের উপরে উঠতে সাহায্য করে তা হল মানসিকতা ও ইচ্ছা। এই মানসিকতা ও ইচ্ছা আছে বলে আমাদের শেফ সহ যুগে যুগে অনেক মানুষ অসাধ্য সাধন করেছে।
আলুর ব্যাপারী কখনো সোনা চেনে না। যে চেনার সে চিনে নেবে। শেফ সব সময় বলে কখনো হাল ছাড়বেনা। কারো কাছে তুমি সামান্য, কারো কাছে তুমি জঘন্য, কারো কাছে তুমি সব তাই কখনো ভেঙে পড়া বা হতাশ হওয়া যাবেনা। আমি যখনই হতাশ হই শেফ জেভিয়ারের সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে শক্তি ও সাহস দেয়, ভরসা দেয়। মনে রাখতে হবে দোষ ধরা যাদের স্বভাব তারা স্বর্গেও ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারেন। আমাদেরও প্রত্যেক বিষয়ের উজ্জ্বল দিকটাই দেখার চেষ্টা করতে হবে। কেবল শ্রেষ্ঠদের বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। শ্রেষ্ঠ সংস্থার জন্য কাজ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো ফল প্রত্যাশা করব। নিজের সাফল্যে যেমন উৎসাহ পাই, অন্যের সাফল্যেও উৎসাহ দেখাবো। অতীত বিচ্যুতি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সাফল্যের চেষ্টা করব। তুমি যা দেবে তাই ফিরে পাবে। শেফ আমাকে সব সময় বলে কথা শুনবে বেশি বলবে কম এটা শেখার একটি বড় গুণ।
- আত্মশক্তি বৃদ্ধি
- স্থিরভাবে শোনা ও বোঝার ক্ষমতা অর্জন করা
- আরো জানার ইচ্ছা অর্জন করা
আমার স্বপ্ন, ইচ্ছা
ছোট থেকে অন্য সবার মত আমার স্বপ্নও ছিল গাড়ি চালানো, তারপর পুলিশ হওয়া, ডাক্তার হওয়া। কোন কিছু বুঝতে শেখার আগে এক এক সময় এক এক কিছু হওয়ার ইচ্ছা ছিল। যখন বুঝতে শিখেছি তখন আমার একটা জিনিস ইচ্ছা ছিল ব্যবসায়ী হওয়ার। কিন্তু এই পেশায় যখন এসেছি তখন থেকে আমার ইচ্ছা একজন ভালো শেফ হওয়ার।
ইনশাল্লাহ একদিন আমি আমার এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারব। ভালো শেফ হতে গেলে অনেক গুণের সংমিশ্রণ লাগে। আগে আমি আমার স্বপ্নকে কিছু ছোট ছোট ভাগে ভাগ করতে চাই। আমি একজন ভালো মানুষ, ভালো ছাত্র, ভালো কুক, ভালো লিডার/নেতা, ভালো কুকিং এক্সপার্ট হতে চাই। এই প্রফেশনে যে সমস্যাগুলো আমি ফেস করেছি তা যেন আমার কোন জুনিয়র কে ফেস করতে না হয় তার ব্যবস্থা করা। আমি এখনো তা করার চেষ্টা করি। কাউকে শেখাতে কৃপণতা করি না। তারপর একজন ভালো শেফ হয়ে আমি বিভিন্ন দেশে ঘুরে বিভিন্ন কালচার তাদের রন্ধন সংস্কৃতি শিখতে চাই। সেই সাথে নিজের পরিবার, শুভাকাঙ্ক্ষী, শিক্ষক, শেফদেরকে সম্মানিত ও গর্বিত করতে চাই।
সম্মানের সাথে বাইরের দেশে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতে চাই। তার সাথে নতুন ইয়াং জেনারেশনকে সঠিক রন্ধন সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশ সম্মত অর্গানিক রন্ধন শিক্ষা ও জ্ঞান দিতে চাই। যাতে তারা নিজেদেরকে বিশ্ব কম্পিটিশনে বাংলাদেশের এই পেশাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া আমি বেকার ছেলে মেয়েদেরকে যাদের কিছু করার ইচ্ছা ও আগ্রহ আছে তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রান্না গুলো ও বিভিন্ন আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা রান্না গুলোকে সংরক্ষণ করতে চাই। আল্লাহ তা’য়লা যেন আমার মনের সকল আশা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার তৌফিক ও শক্তি দেন। এবং আমাকে উপরের প্রতিশ্রুতি গুলো মনে রাখার ও বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য ও শক্তি দান করেন।
আবু সালেহ